ভাগবতে মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বর্ননা রয়েছে । বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে যে বর্ননা দিয়েছেন তা মূলত ভাগবতের পুরো বর্ননার ক্ষুদ্র একটি অংশ বিশেষ । নিম্নে ভাগবত অনুসারে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেওয়া হলো ঃ
ভাগবত অনুসারে পরমানুর সংজ্ঞাঃ
চরমঃ সদ্বিশেষাণামনেকোহসংযুতঃ সদা ।
পরমাণুঃ স বিজ্ঞেয়ো নৃণামৈক্যভ্রমো যতঃ ।। (ভাগবত ৩/১১/১)
অনুবাদঃ জড় জগতের যে ক্ষুদ্রতম অংশ অবিভাজ্য এবং দেহরূপে যার গঠন হয় না, তাকে বলা হয় পরমাণু । এটি সর্বদা এর অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে বিদ্যমান থাকে, এমনকি প্রলয়ের পরেও । জড় দেহ এরকম পরমাণুর সমণ্বয়ে গঠিত কিন্তু সাধারন মানুষের সেই সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে ।
সত এব পদার্থস্য স্বরূপাবস্থিতস্য যৎ ।
কৈবল্যং পরমমহানবিশেষো নিরন্তর ।।(ভাগবত ৩/১১/২)
অনুবাদঃ পরমাণু হচ্ছে ব্যক্ত জগতের চরম অবস্থা । যখন তারা বিভিন্ন প্রকারের শরীর নির্মাণ না করে তাদের স্বরূপে স্থিত থাকে, তখন তাদের বলা হয় পরম মহৎ । ভৌতিকরূপে নিশ্চয়ই অনেক প্রকারের শরীর রয়েছে, কিন্তু পরমাণুর দ্বারা সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয় । এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, পরমাণু দ্বারা জগত গঠিত যা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বলা হয়েছে । ভগবান পরমাণু থেকে শুরু করে বিশাল ব্রহ্মান্ড সব জায়গায় বিরাজিত -
পরমাণুপরমমহতো-সত্বমাদ্যন্তান্তরবর্তী ত্রয়বিধুরঃ ।
আদাবন্তেহপি চ সত্ত্বানাং যদ্ ধ্রুবং তদেবান্তরালেহপি ।।(ভাগবত ৬/১৬/৩৬)
অনুবাদঃ এই জগতে পরমাণু থেকে শুরু করে বিশাল ব্রহ্মান্ড এবং মহত্তত্ত্ব পর্যন্ত সব কিছুরই আদি, মধ্য এবং অন্তে আপনি বর্তমান রয়েছেন অথচ আপনি আদি, মধ্য এবং অন্ত রহিত সনাতন । এই তিনটি অবস্থাতেই আপনার অবস্থা উপলব্ধি করা যায় বলেই আপনি নিত্য । যখন জগতের অস্তিত্ব থাকে না তখনও আপনি আদি শক্তিরূপে বিদ্যমান থাকেন ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রলয়ের সময় পরমাণু ধ্বংস হয়ে শক্তিতে পরিণত হয়, আবার যখন সৃষ্টি শুরু হয় তখন শক্তি থেকে পরমাণু সৃষ্টি হয় । পরবর্তী পোষ্টে আমি আলোচনা করব সৃষ্টির শুরুতে "গর্ভোদক" নামক শক্তি থেকে সবকিছু সৃষ্টি হয় । কোয়ান্টাম তত্ত্বে বর্ণনা করা হয়েছে শক্তি হতে পরমাণু সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু শক্তি আসল কোথা থেকে ? এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা বলেছেন এই মহাবিশ্বে সর্বমোট শক্তির পরিমাণ ০ (শূন্য) । এই প্রশ্নের সাথে এই উত্তরের কি সামঞ্জস্য তা আমি বুঝতে পারছি না । আমাদের প্রশ্ন শক্তি আসল কোথা থেকে ? তার উত্তরে বলল, মহাবিশ্বের সর্বমোট শক্তির পরিমাণ শূন্য । কিভাবে এই সমস্যার সমাধান হল তা আমি বুঝতে পারছি না । শক্তি কোথা থেতে আসল তা নিচের শ্লোকের দ্বারা বুঝা যাবে ।
একোহপ্যসৌ রচয়িতুং জগদন্ডকোটিং যচ্ছক্তিরস্তি
জগদন্ডচয়া যদন্তঃ
অন্ডান্তরস্থপরমাণুচয়ান্তরস্থং
গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম সংহিতায় ৫/৩৫)
অনুবাদ - আমি পরমেশ্বর ভগবান গোবিন্দের ভজনা করি, যিনি তার এক অংশের দ্বারা প্রতিটি ব্রহ্মান্ড এবং প্রতিটি পরমাণুতে প্রবিষ্ট রয়েছেন । এভাবে তিনি সমগ্র সৃষ্টিতে তার অনন্ত শক্তির প্রকাশ করেছেন ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ভগবানের শক্তি পরমাণুতে প্রবেশ করার ফলে সৃষ্টি কার্যক্রম শুরু হয় অর্থাৎ পরমাণু ভগবানের শক্তি থেকে সৃষ্টি হয় । সোজাকথা ভগবান থেকে শক্তি এসেছে । পরবর্তী পর্বগুলিতে আলোচনা করা হবে এই মহাবিশ্ব কিভাবে "প্রধান" নামক একটি চিন্ময় বা বিপরীত পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে । সুতরাং বলা যায় বিজ্ঞানীরা যে অসম্পূর্ণ কণাবাদী তত্ত্ব (Quantum Theory) আবিষ্কার করেছেন ভাগবত সেটাকে আরো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করেছে ।
বৈদিক মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য (The Vedic Concept of Creation of the whole Universe)
মহাবিশ্ব এসেছে কোথা থেকে এবং তা যাচ্ছে বা কোথায় ? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল ? যদি থেকে থাকে তবে তার আগে কি ঘটেছিল ? সময় বা কালের চরিত্র কি ? কাল কি কখনও শেষ হবে ? আমি কে ? আমি কোথা হতে এসেছি ? কোথায় যাব ? এ প্রশ্নগুলো বর্তমানে মানুষের সাধারণ প্রশ্ন । প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবৎ বহু গবেষণা করছেন । বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব, মতবাদ, হাইপোথিসিস, সূত্র প্রভৃতি আবিষ্কার করেছেন । কিন্তু দুঃখের বিষয় বিজ্ঞানীদের এসব তত্ত্ব ও মতবাদগুলো পরস্পর বিরোধী এবং একটির সাথে অপরটির মিল নেই । মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যে মতবাদগুলো প্রদান করেছেন সেগুলো নিম্নরূপঃ
১। আইনষ্টাইনের ব্যাপক আপেক্ষিক তত্ত্ব (Einstein's Law of Relativity)
২। বিগব্যাঙ্গ থিওরী (Big Bang Theory)
৩। বিগ ক্রাঞ্চ (Big Crunch Theory)
৪। বুদবুদ তত্ত্ব (Bubbles Theory)
৫। কণাবাদীতত্ত্ব (Quantum Theory)
৬। মানবতত্ত্ব নীতি (Anthropic Principle) ক) দুর্বল মানবতত্ত্ব নীতি (Weak Anthropic Principle)
খ) সবল মানবতত্ত্ব নীতি (Strong Anthropic Principle)
এই মতবাদগুলো সম্বন্ধেও ভাগবতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । ভাগবতের সাথে মিলিয়ে দেখা গেছে উপরোল্লিখিত মতবাদগুলোর মধ্যে একটির সাথে অপরটির সামঞ্জস্য নাই । কাজেই বর্তমান বিজ্ঞানীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সমাজের মানুষজনের কাছে মহাবিশ্ব সম্বন্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ মতবাদ উপস্থাপন করা ।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁহার A Brief History of Time বইটিতে উল্লেখ করেছেন ভবিষ্যতে পৃথিবীতে হয়তো আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান মানুষের আগমন ঘটবে যারা মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বর্ননা প্রদান করতে পারবে । আমি মনে করি "ভাগবত" মানুষের সেই আদিম ইচ্ছাকে পূরণ করতে সক্ষম। ভাগবতের আলোকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে হলে আমাদের কয়েকটি বিষয় সম্বন্ধে ধারণা নিতে হবে ।
জড় জগত (Material World): আমরা যে জগতে বাস করি তাকে জড় জগত বলে । এই জগত জড় অর্থাৎ প্রাণহীন । জড়জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস আছে । এই সৃষ্টি ও ধ্বংস কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে চক্রাকারে চলতে থাকে অর্থাৎ প্রথমে সৃষ্টি হয় তারপর কিছুদিন অবস্থান করে , কিছুদিন পর আবার ধ্বংস হয় । সুতরাং এই জড় জগতের সৃষ্টি ,অবস্থান এবং ধ্বংস শাশ্বত নিয়মেই চলতে থাকে । অর্থাৎ জড় জগত পুণঃপুণঃ সৃষ্টি ও ধ্বংস হয় । এবার দেখা যাক জড় জগতের পুনঃপুনঃ সৃষ্টি ও ধ্বংস সম্পর্কে ভাগবত কি বলেঃ
সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতং যান্তি মামিকাম্ ।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্ ।।
প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ ভূতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ ।। (ভাগবত ২/১০/৩)
অনুবাদঃ কল্পান্তে সমগ্র সৃষ্টি তথা জড় জগত এবং প্রকৃতিতে ক্লেশ প্রাপ্ত জীব আমার দিব্য দেহে লয় প্রাপ্ত হয় এবং নতুন কল্পের আরম্ভে আমার ইচ্ছার প্রভাবে তারা পুণরায় প্রকাশিত হয় । এ ভাবে প্রকৃতি আমার নিয়ন্ত্রনে পরিচালিত হয় । আমার ইচ্ছার প্রভাবে তাহা পুণঃপুণঃ প্রকট হয় এবং লয় হয় ।
স এষ আদ্যঃ পুরুষঃ কল্পে কল্পে সৃজত্যজঃ ।
আত্মাত্মন্যাত্মনাত্মানং স সংযচ্ছতি পাতি চ ।। (ভাগবত ২/৬/৩৯)
অনুবাদঃসেই আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মরহিত হওয়া সত্ত্বেও প্রথম অবতার মহাবিষ্ণু রূপে নিজেকে বিস্তার করে এই ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি করেন । তার মধ্যেই সৃষ্টি প্রকাশিত হয় এবং জড় পদার্থ ও জড় অভিব্যক্তি সবই তিনি কিছুকালের জন্য পালন করেন এবং তারপর তিনি পুণরায় তাদের আত্মসাৎ করে নেন ।
উপরের শ্লোক দুটি থেকে বুঝা যায় জড়জগত পুণঃপুণঃ সৃষ্টি এবং ধ্বংস হচ্ছে । আমরা জড় জগতের একটি ব্রহ্মান্ডের মধ্যে অবস্থিত পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাস করছি । এরকম অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ড নিয়ে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড গঠিত । এই ব্রহ্মান্ডগুলোর সমষ্টি বা বিশ্বব্রহ্মান্ডকেই জড় জগত বা Material World বলে ।
এবার দেখা যাক ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা ও ব্রহ্মান্ডের আবরন (Layer) সম্পর্কে ভাগবত কি বলেঃ
ক্ষিত্যাদিভিরেষ কিলাবৃতঃ সপ্তভির্দশগুণোত তরৈরন্ডকোশঃ ।
যত্র পতত্যণুকল্পঃ সহস্রকোটিকোটিভি স্তদনন্তঃ ।। (ভাগবত ৬/১৬/৩৭)
অনুবাদঃপ্রতিটি ব্রহ্মান্ড মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ, মহতত্ত্ব এবং অহংকার নামক এই সাতটি আবরণের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং প্রতিটি আবরন পূর্ববর্তী আবরন থেকে দশগুন অধিক প্রশস্ত । এই ব্রহ্মান্ডটি ছাড়া আরও কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড রয়েছে এবং সেইগুলি আপনার (শ্রীকৃষ্ণের) মধ্যে পরমাণুর মতো পরিভ্রমণ করিতেছে । তাই আপনি অনন্ত নামে প্রসিদ্ধ । এই শ্লোকে আরোও বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা কোটি কোটি । জড় জগত সম্বন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণা সঠিক কারণ বিজ্ঞানও বলেছে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র নিয়েই এই মহাবিশ্ব তথা বিশ্বব্রহ্মান্ড গঠিত ।
প্রতিটি ব্রহ্মান্ড কতগুলো গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি নিয়ে গঠিত । যেমনঃ আমাদের সৌর পরিবারের সাথে আরো কিছু গ্রহ নক্ষত্র যোগ করলে আমাদের ব্রহ্মান্ড গঠিত হয় । ভাগবতে বলা হয়েছে প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডের একটি নির্দিষ্ট আয়তন ও আবরণ রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ব্রহ্মান্ডের ব্যাস আলাদা আলাদা । এবার দেখা যাক আমাদের ব্রহ্মান্ডের আবরণের প্রকৃতি ও ব্যাস সম্পর্কে ভাগবত কি বলেঃ
বিকারৈঃ সহিতো যুক্তৈর্বিশেষাদিভিরাবৃতঃ।
আন্ডকোশো বহিরয়ং পঞ্চাশৎ কোটিবিস্তৃতঃ॥(ভাগবত ৩/১১/৪০)
অনুবাদঃ আটটি জড় উপাদানের সমন্বয়ে ১৬ প্রকার বিকার থেকে এই ব্রহ্মান্ডের আবরণ গঠিত । ব্রহ্মান্ডের আবরণের উপাদানগুলোকে বিকারগ্রস্ত বলা হয়েছে অর্থাৎ বলা যেতে পারে উপাদানগুলো গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা তৈরী । আবরনগুলো বিকারগ্রস্থ হওয়ায় পরেও আলোক রশ্মি এক ব্রহ্মান্ড থেকে অন্য ব্রহ্মান্ডে গমন করতে পারে ।
এই শ্লোকের দ্বিতীয় অংশে ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের কথাও বর্ণনা করা হয়েছে । শ্লোক অনুযায়ী ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০কোটি যোজন বা ৪০০কোটি মাইল । আমাদের ব্রহ্মান্ডকে ৪গুন ধরে অন্য ব্রহ্মান্ডগুলি বড় হতে থাকে অর্থাৎ আমাদের পরবর্তী ব্রহ্মান্ডের আয়তন ৫গুণ। ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে মহাবিশ্বে এরূপ হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গুণ বড় ব্রহ্মান্ডও রয়েছে।
এবার দেখা যাক ব্রহ্মান্ডের আবরনের প্রশস্ততা সম্পর্কে ভাগবত কি বলেঃ
দশোত্তরাধিকৈর্যত্র প্রবিষ্টঃ পরমাণুবৎ।
লক্ষ্যতেহন্তর্গতাশ্চান্যে কোটিশো হ্যন্ডরাশয়ঃ॥ (ভাগবত ৩/১১/৪১)
অনুবাদঃব্রহ্মান্ডকে আবৃত করে যে সমস্ত তত্ত্ব অবস্থিত তা উত্তরোত্তর দশগুন অধিক বিস্তৃত এবং সমস্ত ব্রহ্মান্ডগুলি এক বিশাল পরমাণুর সমন্বয়ের মতো প্রতিভাত হয় ।
এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডের প্রথম আবরন থেকে দ্বিতীয় আবরণ দশ গুন প্রশস্ত । তৃতীয় আবরণ আবার দ্বিতীয় আবরণ থেকে দশ গুন প্রশস্ত । এভাবে ক্রমান্বয়ে আবরণগুলোর বিস্তৃতি বাড়তে থাকে । শ্লোকের দ্বিতীয় অংশে আরো বর্ণনা করা হয়েছে আবরণগুলো বৃত্তাকারভাবে ব্রহ্মান্ডকে ঘিরে রেখেছে এজন্য এটা দেখতে একটি পরমাণুর মত গোলাকার ।
ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি এতদন্ডং বিশেষাখ্যং ক্রমবৃদ্ধৈর্দশোত্তরৈঃ।
তোয়াদিভিঃ পরিবৃতং প্রধানেনাবৃতৈর্বহিঃ।
যত্র্রলোকবিতানোহয়ং রূপং ভগবতো হরেঃ॥(ভাগবত ৩/২৬/৫২)
অনুবাদঃএই ব্রহ্মান্ডকে বলা হয় জড়া প্রকৃতির প্রকাশ। এর জল,অগ্নি,বায়ু,আকাশ,অহংকার এবং মহত্তত্ত্বের যে আবরণ রয়েছে,তা ক্রমান্বয়ে পূর্বটির থেকে পরবর্তী আবরণটি দশ গুণ অধিক এবং এর শেষ আবরনটি হচ্ছে "প্রধানের" আবরণ । এই ব্রহ্মান্ডে ভগবানের বিরাটরূপ বিরাজ করছে ,যার দেহের একটি অংশ হচ্ছে চতুর্দশ ভুবন ।
এই শ্লোকে ব্রহ্মান্ডের ৭টি আবরণের পদার্থের নাম উল্লেখ করা হয়েছে । প্রতিটি আবরণ পূবটির থেকে ১০ গুণ প্রশস্ত । যেমন ব্রহ্মান্ডের প্রথম আবরণটি জলের (H ও O) দ্বারা তৈরী । ব্রহ্মান্ডের ব্যাস ৫০ কোটি যোজন অর্থাৎ জলের আবরণ ৫০×১০=৫০০ কোটি যোজন পুরু।এইভাবে পরবর্তী আবরণগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যদি ব্রহ্মান্ডের ব্যাস X ধরা হয় তা হলে ব্রহ্মান্ডের আবরণকে নিম্নলিখিত ভাবে প্রকাশ করা যায়।
ব্রহ্মান্ডের আবরণগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
১ম আবরণ ১০×X=১০X বিস্তৃতি/চওড়া জল (H ও O) দিয়ে তৈরী ।
২য় আবরণ ১০X×১০=১০০X বিস্তৃতি/চওড়া আগুন দিয়ে তৈরী ।
৩য় আবরণ ১০০X×১০=১০০০X বিস্তৃতি/চওড়া বায়ু দিয়ে তৈরী ।
৪র্থ আবরণ১০০০X×১০=১০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া আকাশ (ইথার) দিয়ে তৈরী ।
৫ম আবরণ ১০০০০X×১০=১০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া অহংকার (সূক্ষ্ম পদার্থ যা সাধারণভাবে অনুভব করা যায় না কিন্তু ইহা জড় পদার্থ ) দিয়ে তৈরী ।
৬ষ্ঠ আবরণ ১০০০০০X×১০=১০০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া মহতত্ত্ব (বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরীর প্রাথমিক পদার্থ যা দ্বারা ব্রহ্মান্ড তৈরী হয়) দিয়ে তৈরী ।
৭ম আবরণ ১০০০০০০X×১০=১০০০০০০০X বিস্তৃতি/চওড়া প্রধান (সূক্ষ্ম অব্যক্ত বস্তু , যা অনুভব করা যায় না, ইহাকে সাধারণভাবে শূন্যস্থান বলা যেতে পারে)
মোট ৭টি আবরণ = ১১১১১১১০X বিস্তৃতি/চওড়া ।
উপরের হিসাব থেকে দেখা যায় ব্রহ্মান্ডের মোট আবরণের বিস্তৃতি ব্রহ্মান্ডের ব্যাসের ১কোটি ১১লক্ষ গুণ অধিক , এভাবে হিসাব করলে দেখা যায় আমাদের পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মান্ডের আবরণের বিস্তৃতি আমাদের ব্রহ্মান্ডের চেয়ে একটু বেশি কারণ আমাদের নিকটতম ব্রহ্মান্ডটি ৫গুণ আর আমাদের ব্রহ্মান্ডটি ৪গুণ সুতরাং আমাদের ব্রহ্মান্ডের চেয়ে পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মান্ডের আবরন একটু বেশিই পুরু হবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন আদিম মহাবিশ্ব সম্ভবত অত্যন্ত বিশৃংঙ্খলা এবং নিয়মবিহীন অবস্থায় ছিল । বিজ্ঞানীদের ধারনা মহাবিশ্ব যদি সত্যিই স্থানিকভাবে অসীম হয় কিংবা মহাবিশ্বগুলির সংখ্যা যদি অনন্ত হয় তা হলে সম্ভবত কোন স্থানে এমন কতগুলো বৃহৎ অঞ্চল থাকবে যেগুলো হয়েছিল মসৃণ-সমরূপভাবে । বিজ্ঞানীদের এই মতবাদের সাথে ভাগবত একমত । কারণ ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মান্ডের সংখ্যা অনন্ত কোটি এবং প্রত্যেক ব্রহ্মান্ডে গ্রহ-নক্ষত্রসহ অসংখ্য সুশৃঙ্খল সৌর পরিবার রয়েছে । প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের মাঝখানে একটি সূর্য অবস্থান করে সম্পূর্ণ ব্রহ্মান্ডকে তাপ ও আলো প্রদানের মাধ্যমে জীবিত রেখেছে এবং প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে আমাদের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান মানুষসহ ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব রয়েছে ।
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদন্ডকোটিকোটিষবশেষবসুধাদিবিভূতিভিন্নম্ ।
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমেষভূতং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম- সংহিতা ৫/৪০)
অনুবাদঃ অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ডে অনন্ত বসূধাদি বিভূতির দ্বারা যিনি ভেদপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেই পূর্ণ, নিরবিচ্ছিন্ন এবং অশেষভূত ব্রহ্ম যার প্রভা, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।
অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি ব্রহ্মান্ডেই বিভিন্ন আয়তনের এবং বিভিন্ন পরিবেশের অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্রে পরিপূর্ণ । যার সবকিছু প্রকাশিত হয়েছে অনন্ত অদ্বয়-ব্রহ্ম থেকে, যা পূর্ণ জ্ঞানে বিরাজমান । সেই অন্তহীন ব্রহ্মজ্যোতির উৎস হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীগোবিন্দের (শ্রীকৃষ্ণের) চিন্ময় দেহ এবং সেই গোবিন্দই আদি পুরুষরূপে বন্দিত হয়েছেন।
সনাতন ধর্ম সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
আরো জানুনঃ
কেন প্রসাদভোজী হবেন? সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র (বেদ,সংহিতা, মহাভারত, গীতা,ভাগবত,পুরাণ,উপনিষদ) থেকে প্রমান দেওয়া হলো...
চার যুগ-সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর ও কলির সময় পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
0 মন্তব্যসমূহ