শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সর্ম্পকে কিছু বহিরঙ্গা জ্ঞান
১। গীতা হচ্ছে সমস্ত শাস্ত্রের সারতিসার এমন কি গীতায় এমন কিছু আছে যা অন্যান্য কোন শাস্ত্রে পাওয়া যায় না । যেমন - ৫ম পুরুষার্থ
২। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫ থেকে ৪২ নং অধ্যায়ের এই ১৮ টি অধ্যায় হল ভগবদগীতা বা গীতোপনিষদ ।
৩। গীতায় আছে ৭০০ শ্লোক (কেউ বলে ৭৪৫ শ্লোক) আছে । তার মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র বলেন ১টি শ্লোক, সঞ্জয় বলেন ৪০টি শ্লোক, অর্জুন বলেন ৮৫টি শ্লোক, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন ৫৭৪টি শ্লোক । আর পুরো গীতায় ৯৫৮০ টি সংস্কৃত শব্দ আছে ।
৪। গীতার ১৮টি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ৬টি অধ্যায়কে বলে কর্মষটক, মাঝখানের ৬টি অধ্যায়কে বলে ভক্তিষটক, আর বাকি ৬টি অধ্যায়কে বলে জ্ঞানষটক । এর মধ্যে ভক্তিষটক হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ । আর ভক্তিষটকের মধ্যে ৯ম অধ্যায় হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ আর ৯ম অধ্যায়ের মধ্যে ৩৪ নং শ্লোক সর্বশ্রেষ্ঠ।
৫। গীতা পড়লে ৫টি জিনিষ সর্ম্পকে জানা যায়-ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম । ৬। যদিও গীতার জ্ঞান ৫০০০ বছর আগে বলেছিল কিন্তু ভগবান চতুর্থ অধ্যায় বলেছেন এই জ্ঞান তিনি এর আগেও বলেছেন, মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৪৮/৫২-৫২) গীতার ইতিহাস উল্লেখ আছে । তার মানে গীতা প্রথমে বলা হয় ১২,০৪,০০,০০০ বছর আগে, মানব সমাজে এই জ্ঞান প্রায় ২০,০০,০০০ বছর ধরে বর্তমান, কিন্তু কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেলে পুনরায় আবার তা অর্জুনকে দেন ।
৭। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মাত্র ৪০ মিনিটে এই গীতার জ্ঞান দেন ।
৮। গীতার মাহাত্ম্য অনেকে করে গেছেন তার মধ্যে শ্রীশঙ্করাচার্য, স্কন্দপুরাণ থেকে শ্রীলব্যাসদেব, শ্রীবৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারে গীতামাহাত্ম্য আর আছে পদ্মপুরাণে দেবাদিদেব শিবকর্তৃক ১৮টি অধ্যায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন ।
৯। গীতাতে অর্জুনের ২০টি নাম আর কৃষ্ণের ৩৩টি নামের উল্লেখ করা হয়েছে । ১০। গীতাতে মাং এবং মামেব কথাটি বেশি আছে, যোগ শব্দটি আছে ৭৮ বার, যোগী আছে ২৮ বার আর যুক্ত আছে ৪৯ বার ।
১১। গীতার ২য় অধ্যায়কে বলা হয় গীতার সারাংশ ।
১২। ভগবান যখন বিশ্বরূপ দেখান তখন কাল থেমে যায় ।
১৩। ভগবান শুধু যুদ্ধের আগেই গীতা বলেনি ১৮ দিন যুদ্ধের মাঝখানেও গীতা বলেছে ।
১৪। গীতায় অর্জুন ১৬টি প্রশ্ন করে আর কৃষ্ণ তা ৫৭৪টি শ্লোকের মাধ্যমে উত্তর দেন ।
১৫। পুরো গীতার সারমর্ম মাত্র ৪টি শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, ১০ অধ্যায়ের ৮ থেকে ১১ নং শ্লোক ।
১৬। পুরো গীতায় অর্জুন ৪৫ নামে কৃষ্ণকে সম্বোধন করছেন, আর কৃষ্ণ অর্জুনকে ২১টি নামে সম্বোধন করেছেন ।
১৭। গীতার ৫ম অধ্যায় ১৩ থেকে ১৬ নং শ্লোকে তিনজন কর্তার কথা বলা হয়েছে । ১৮। গীতায় ৩টি গুণ, ৩টি দুঃখ আর ৪টি আমাদের প্রধান সমস্যার কথা বলেছে । ১৯। ত্রিশ্লোকী গীতার জ্ঞান: যা বেদ ও বেদান্তের সার, ১৫ অধ্যায়ের ১৬ থেকে ১৮ নং শ্লোক ।
২০। গীতায় ২৬টি গুণের কথা বলা হয়েছে আর ৬টি আসুরিক প্রবৃত্তির কথা বলা হয়েছে ।
২১। নরকের ৩টি দ্বারের কথা বলা হয়েছে (কাম, ক্রোধ ও লোভ)
২২। গীতার ১৮ অধ্যায় ব্রাহ্মণের ৯টি গুণ, ক্ষত্রিয়ের ৭টি গুণ, বৈশ্যের ৩টি গুণ আর শুদ্রের ১টি গুণের কথা বলা হয়েছে ।
২৩। ৩টি কর্মের প্রেরণা আর ৩টি কর্মের আশ্রয়ের কথা বলা আছে ।
২৪। বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত অনুসারে কর্মসমূহের সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ৫টি নির্দিষ্ট কারনের কথা বলা হয়েছে ।
২৫। গুণ অনুসারে ৩ প্রকারের ত্যাগের কথা বলা হয়েছে ।
২৬। ৩ প্রকারের আহার, যজ্ঞ, তপস্যা, শ্রদ্ধা, পূজা ও দানের কথা বলা হয়েছে । ২৭। ২টি স্বভাবের জীবের কথা বলা হয়েছে ।
২৮। ২ প্রকার জীবের কথা বলা হয়েছে ।
২৯। ১৮টি আত্মজ্ঞানের সাধনার গুণের কথা বলা হয়েছে ।
৩০। ব্রক্ষ্ উপলব্ধির ৫টি স্তরের কথা বলা হয়েছে ।
৩১। ভক্তদের ৩৬ টি গুণের কথা বলা হয়েছে ।
৩২। গীতায় ২৫ জন সৃষ্টের কথা বলা হয়েছে যারা স্থাবর, জঙ্গম ও সমস্ত প্রজাদের সৃষ্টি করেছেন ।
৩৩। গীতায় নারীর ৭টি গুণের কথা বলা হয়েছে ।
৩৪। ৪ প্রকার সুকৃতিবান ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে । আর ৪ প্রকার দুষ্কৃতিবানের কথা বলা হয়েছে ।
৩৫। জড়া প্রকৃতির ৮টি উপাদানের কথা বলা হয়েছে । (সংক্ষিপ্ত) ভগবদ্গীতা সম্পর্কিত জ্ঞাতব্য বিষয়সমূহ
ভগবদ্গীতা কী?
যথার্থ ভগবদতত্ত্ববিজ্ঞান, কারণ পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং তা ব্যক্ত করেছেন।
সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের সারাতিসার, মুকুটমনিস্বরূপ।
সমস্ত বৈদিক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপনিষদ, যার অপর নাম "গীতোপনিষদ"
স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী, তাই তা অপৌরুষেয়।
মহাভারতের সারাংশ ভীষ্মপর্বের ২৫-৪২ অধ্যায়।
সমগ্র মানবজাতি তথা জীবকুলের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান (Complete Manual Guide)।
এর দ্বারা মানুষ নিজেকে ও পরমেশ্বর ভগবানকে যথাযথভাবে জানতে পারে।
# ভগবদ্গীতার বিশেষত্ব
অন্য শাস্ত্রে যা আছে তার সবই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আছে, তদুপরি অন্য শাস্ত্রের কোথাও যা নেই, তাও এতে আছে।
# গীতা অধ্যায়নের উদ্দেশ্য
জগজ্জীবন ও ভগবান সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা।
গীতার জ্ঞান উপলব্ধিপূর্বক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুসারে জীবনকে পরিচালিত করা।
সকল বদ্ধজীবকে গীতার জ্ঞান দানপূর্বক তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা।
# ভগবদ্গীতার বিষয়বস্তু ৫টি মূল বিষয় - ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম।
পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের আধার - গুহ্য, গুহ্যতর ও গুহ্যতম জ্ঞানের আধার।
# ভগবদ্গীতা পাঠের যোগ্যতা
তত্ত্বজ্ঞ সদ্গুরুর শরণাগত হওয়া (গীতা ২/৭)
যথার্থ পরম্পরায় যুক্ত গুরুদেবের শরণাগত হয়ে তাঁর সেবার পাশাপাশি বিনয়ের সাথে তত্ত্বজিজ্ঞেস করা (গীতা ৪/৩৪) সম্পূর্ণরূপে পাপমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা (গীতা ৩/৩)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হওয়া (গীতা ৪/৩)
শ্রদ্ধাবান, তৎপর ও সংযত হওয়া (গীতা ৪/৩৯) সম্পূর্ণরূপে নিমৎসর হওয়া (গীতা ৯/১)
# কোন ভাব নিয়ে ভগবদ্গীতা পাঠ করা উচিত
অর্জুন যেভাবে গীতার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন, ঠিক সে দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব নিয়ে সকলেরই গীতা পাঠ করা উচিত। তবেই গীতার যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব (গীতার তাৎপর্য ১/১)
ঠিক যেমন আমরা আমাদের ইচ্ছামতো ঔষধ খেতে পারি না, অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ এবং সংশ্লিষ্ট নির্দেশিকা মেনে তা খেতে হয়। তেমনি ভগবদ্গীতার জ্ঞানও ভগবদ্গীতার বক্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অথবা তাঁর সুযোগ্য প্রতিনিধির নির্দেশ অনুসারে অধ্যয়ন ও ব্যক্তজীবনে প্রয়োগ করতে হয়।
#ভগবদ্গীতা পাঠের ফল
সমস্ত বৈদিক জ্ঞানসহ জগতের সমস্ত তত্ত্ব জানা হয়ে যায়; আর কোনো তত্ত্ব জানার বাকি থাকে না (গীতা ৭/২ ও ৪)
সম্পূর্ণভাবে মোহমুক্ত হওয়া যায় (গীতা ১৮/৭২-৭৩)
পাপ ও পূণ্য উভয় প্রকার কর্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া যায় (গীতা ৪/৩৬-৩৭, গীতা ২)
সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় (গীতা ৯/১-২)
সৃষ্টিকালে পুনরায় জন্মগ্রহন করতে হবে না এবং প্রলয়কালে ব্যথিত হতে হবে না (গীতা ১৪/২ ও ৫)
ভগবানের নিত্যধাম লাভ করে নিত্য চিন্ময় আনন্দ লাভ করা যায় (গীতা ৪/৯)নিয়মিত গীতা পাঠ করলে – যিনি নিয়মিত গীতা অধ্যয়ন করেন, তাঁর সেই জ্ঞানযজ্ঞের দ্বারা আমি পূজিত হই (গীতা ১৮/৭০)
#নিয়মিত শ্রবণ করলে - কেউ যদি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে নিয়মিত গীতা শ্রবণ করেন, তবে তিনি পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যকর্মকারীদের শুভলোক প্রাপ্ত হন (গীতা ১৮/৭১)।
# গীতাজ্ঞান কাউকে দান বা প্রচার করলে কী লাভ? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন-
যিনি আমার ভক্তদের মধ্যে এ পরম গোপনীয় গীতাবাক্য উপদেশ দান করেন, তিনি অবশ্যই পরাভক্তি লাভ করে নিঃসন্দেহে আমার কাছে ফিরে আসবেন। (গীতা ১৮/৬৮)
এ পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে তাঁর মতো আমার অধিক প্রিয়কারী আর কেউ নেই এবং তাঁর চেয়ে আমার প্রিয়তর কেউ হবে না (গীতা ১৮/৬৯)
কৃপা করে পড়বেন🙏🙏
সনাতন ধর্ম বিষয়ক ১০০টি প্রশ্ন ও উত্তর:
১। পঞ্চ মহাভূত কি?
উঃ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম।
২। আত্মা কি?
উঃ জীবাত্মা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৩। আত্মার নিত্যধর্ম কি?
উঃ ভগবান পূর্ণ, আত্মা তার অংশ, তাই জীবাত্মার নিত্য ধর্ম হচ্ছে ভগবানের সেবা করা, কেন না অংশের কাজ হচ্ছে পূর্ণের সেবা করা।
৪। মনের ধর্ম কি?
উঃ মনের ধর্ম সংকল্প ও বিকল্প।
৫। দেহের ধর্ম কি?
উঃ দেহের ধর্ম ভোগ আর ত্যাগ।
৬। দেহের ছয়টি পরিবর্তন কি কি?
উঃ *জন্ম *বৃদ্ধি *সন্তান-সন্তুতি সৃষ্টি *স্থিতি *ক্ষয় *মৃত্যু।
৭। জীবের 'স্বরূপ' কি?
উঃ জীবের 'স্বরূপ' হয় কৃষ্ণের নিত্যদাস।
৮। আত্মার আকার কি?
উঃ আত্মার আকার চুলের অগ্রভাগের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ। তা এতই ক্ষুদ্র যে এই জড় চক্ষু দিয়ে বা যন্ত্রের সাহায্যে আত্মাকে দর্শন করা যায় না। এ ছাড়া আত্মা জড় পদার্থ নয়, তাই জড়ীয় ইন্দ্রিয় ও যন্ত্র দিয়ে তা দেখা অসম্ভব।
৯। জড় জগৎ কি?
উঃ জড় জগৎটি ভগবানের বহিরঙ্গা ত্রিগুণাত্মিকা মায়া শক্তির প্রকাশ।
১০। কি কি উপাদান দিয়ে জড়-জগৎ তৈরী হয়েছে?
উঃ ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহংকার এই আটটি উপাদান দিয়ে এই জড়-জগৎ তৈরী হয়েছে।
১১। আমি কে?
উঃ আমি চিন্ময় আত্মা, স্থুল জড় দেহ নই।
১২। ইন্দ্রিয়ের পাঁচটি বিষয় কি কি?
উঃ রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ র্স্পশ।
১৩। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় কি কি?
উঃ নাক, জিভ, চোখ, কান ও ত্বক।
১৪। পঞ্চ কমেন্দ্রিয় কি?
উঃ বাক, পানি, পাদ, উপস্থ, পায়ু।
১৫। স্থূল শরীরটি কি কি উপাদান দিয়ে তৈরী?
উঃ জীবের স্থূল শরীর ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি ও আকাশ দিয়ে তৈরী।
১৬। জীবের সূক্ষ্ম শরীরটি কি উপাদান দিয়ে তৈরী?
উঃ জীবের সূক্ষ্ম শরীরটি মন, বুদ্ধি ও অহংকার দিয়ে তৈরী।
১৭। জীবের মৃত্যুর পর তার কি গতি হয়?
উঃ জীবের মৃত্যুর পর দুই প্রকার গতি হয়।
এক-- যে সমস্ত জীর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট আত্মসর্মপণ করে, তারা ভগবদ্ভজনের প্রভাবে সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে নিত্য আলয় ভগবদ্ধামে গমন করে। সেখানে তারা দিব্য শরীর প্রাপ্ত হয়ে নিত্যকালের জন্য ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হয়।
দুই-- যাদের জড়জাগতিক কামনা বাসনা আছে, তারা মৃত্যুর মাধ্যমে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম দিয়ে তৈরী স্থুল শরীরকে পরিত্যাগ করে। কিন্তু মন, বুদ্ধি ও অহংকার নির্মিত সূক্ষ্ম শরীর তাদের পাপ ও পূর্ণ কর্মফল বহন করে। পাপ কর্মের ফলস্বরূপ তারা যমযাতনা ভোগ করে আর পূর্ণ কর্মের ফলস্বরূপ স্বর্গসুখ ভোগ করে থাকে। এই ভোগের পর তাদের নিজ নিজ কর্ম ও চেতনা অনুসারে তারা আর একটি স্থুল জড় শরীর প্রাপ্ত হয়। এভাবে ৮৪ লক্ষ জীব প্রজাতির যে কোন একটি প্রজাতিতে তাদের জন্মগ্রহণ করতে হয়।
১৮। দেহ ও আত্মার পার্থক্য কি?
উঃ জড় বস্তুর দ্বার নির্মিত শরীর সদা পরিবর্তনশীল, নশ্বর, বিনাশশীল, অনিত্য, স্থুল, বহিরঙ্গা জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি। জড়দেহ অচেতন, পরিমাপযোগ্য; তাকে কাটা যায়, শুকানো যায়, পোড়ানো যায়, ভেজানো যায়, তা দুঃখ ক্লেশের আধার স্বরূপ।
আত্মা অপরিবর্তনীয়, অব্যয়, অক্ষয়, অবিনশ্বর নিত্য, সনাতন, সূক্ষ্ম, অপরিমেয়, ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, চেতন, অনেক, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, সর্বব্যাপ্ত, আনন্দময়।
১৯। জড় পদার্থ ও চিন্ময় বস্তু আত্মার মধ্যে পার্থক্য কি ?
উঃ জড় বস্তু চিন্ময় আত্মা
১। ভগবানের বহিরঙ্গা ১। ভগবানের অন্তরঙ্গা
প্রকৃতিজাত। প্রকৃতি হতে উদ্ভূত।
২। অচেতন, অজ্ঞান ২। চেতনাময়, জ্ঞানময়।
বস্তুপিণ্ড মাত্র।
৩। জড় ইন্দ্রিয় দ্বারা ৩। জড় ইন্দ্রিয়ের
অনুভবযোগ্য অগোচর।
৪। ব্যক্তিত্বহীন। ৪। ব্যক্তিত্বের কেন্দ্র,
প্রকৃত 'আমি'।
২০। আত্মা শরীরের কোন স্থানে অবস্থান করে?
উঃ আত্মা শরীরের হৃদ্দেশে অবস্থান করে।
২১। দেহে আত্মার অবস্থানের লক্ষণ কি?
উঃ দেহে আত্মার অবস্থানের লক্ষণ হচ্ছে দেহে পরিব্যাপ্ত চেতনা। যে পর্যন্ত একটি দেহে আত্মার উপস্থিতি থাকে, সে পর্যন্ত ঐ জীর দেহে চেতনা প্রকাশিত থাকে। আত্মা-দেহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলে দেহ একটি অচেতন, পচনশীল, জড়পিণ্ডে পরিণত হয়।
২২। জীব কত প্রকারের?
উঃ জীব তিন প্রকারের ১) নিত্যবদ্ধ ২) নিত্যমুক্ত ৩) বন্ধনমুক্ত। ভগবদবিমুখ জীব যারা এই জড় জগতে ত্রিগুণাত্মিকা মায়াশক্তির প্রভাবে বদ্ধ হয়ে আছে ও জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তাদেরকে নিত্যবদ্ধ জীব বলা হয়।
যে সমস্ত জীব ভগবদ্ভজন করে এই বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময় জগতে প্রবেশে উন্মুখ, তাদেরকে বন্ধনমুক্ত জীব বলা হয়।
২৩। এই জড় জগতে কত প্রকার জীব প্রজাতি রয়েছে? তাদের বর্ণনা দাও।
উঃ এই জড় জগতে ৮৪ লক্ষ জীব যোনি রয়েছে। এদের মধ্যে কীটপতঙ্গ ১১ লক্ষ, জলচর ৯ লক্ষ, উদ্ভিদ ২০ লক্ষ, পশু ৩০ লক্ষ, পক্ষী ১০ লক্ষ এবং মানুষের মধ্যে রয়েছে ৪ লক্ষ প্রজাতি।
২৪। জীবের প্রকৃত সমস্যা বা দুঃখ কি?
উঃ জীবের প্রকৃত সমস্যা বা দুঃখ হচ্ছে-- জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি।
২৫। ত্রিতাপ ক্লেশ কি?
উঃ জড় জগতে অবস্থান কালে জীবাত্মা যে তিন রকম অবশ্যম্ভাবী দুঃখ লাভ করে তাকে বলা হয় ত্রিতাপ ক্লেশ। সেগুলি হচ্ছে---
(১) আধিভৌতিক ক্লেশ
(২) আধিদৈবিক ক্লেশ
(৩) আধ্যাত্মিক ক্লেশ।
জীব তার নিজের মন ও শরীর থেকে যে ক্লেশ প্রাপ্ত হয় তা আধ্যাত্মিক ক্লেশ। যেমনঃ মানসিক কষ্ট এবং রোগ ব্যাধি ইত্যাদি।
অন্য জীব থেকে প্রাপ্ত ক্লেশকে আধিভৌতিক ক্লেশ বলা হয়। যেমনঃ সাপের কামড়, মশা-মাছি, চোর-গুণ্ডার উপদ্রব ইত্যাদি।
দৈবক্রমে অর্থাৎ দেবতাদের দ্বারা প্রদত্ত যে ক্লেশ, তাকে আধিদৈবিক ক্লেশ বলা হয়। যেমনঃ অনাবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প।
২৬। জীব-চেতনা কয় প্রকার ও কি কি?
উঃ পাঁচ প্রকার - (১) আচ্ছাদিত চেতন, (২) সংকুচিত চেতন, (৩) মুকুলিত চেতন, (৪) বিকশিত চেতন, (৫) পূর্ণ বিকশিত চেতন। পাহাড়, বৃক্ষ আদিতে যে চেতনা, তাকে আচ্ছাদিত চেতনা বলা হয়। পশু, পাখিরা হচ্ছে সংকুচিত চেতন জীব। সাধারণ মানুষ হচ্ছে মুকুলিত চেতন। মানুষের মধ্যে যাঁরা ভগবদ্ভজনে নিযুক্ত হয়েছেন তারা হচ্ছেন বিকশিত চেতন। আর ভগবদ্ভজনে যাঁরা সিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁদের চেতনাকে পূর্ণ বিকশিত চেতনা বলা হয়।
২৭। পুনর্জন্ম কি?
উঃ জীবাত্মা যে শরীরের মধ্যে অবস্থান করে সেই শরীর কৌমার থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বার্ধক্য অবস্থায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু দেহস্থ আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। ঠিক যেমন পুরানো কাপড় পরিত্যাগ করে নূতন কাপড় পরিধান করা হয়, ঠিক তেমনি জীবাত্মা অব্যবহারযোগ্য জরাজীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করে তার কর্ম এবং বাসনা অনুসারে আরেকটি নূতন শরীর গ্রহন করে। আত্মার এই নূতন শরীর ধারণকে বলা হয় পুনর্জন্ম।
২৮। কর্মবন্ধন কি?
উঃ জীব এই জগতে বিভিন্ন প্রকারের জড় কামনা বাসনা নিয়ে কর্ম করে থাকে। কিন্তু সে তার প্রতিটি কৃতকর্মের ফলভোগ করতে বাধ্য থাকে। সেই কর্ম অনুসারে তাকে বারবার জড় শরীর ধারণ করতে হয়। নূতন শরীরে সে নূতন কর্ম করে ও ঐসব কর্মের ফল ভোগের জন্য আবার তাকে জন্ম নিতে হয়। এ রকম চলতেই থাকে। এইরূপ বদ্ধ অবস্থাকে বলা হয় কর্ম বন্ধন।
২৯। জীবের চরম লক্ষ্য কি?
উঃ জীবের চরম লক্ষ্য হচ্ছে - পরমেশ্বর ভগবানের সংগে তার হারানো সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হওয়া, কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা।
৩০। আনন্দের উৎস কি?
উঃ সর্ব আনন্দের উৎস হচ্ছেন সচ্ছিদানন্দময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। জীব যে নিত্য আনন্দ লাভের আশা করছে, তার জন্য তাঁকে পরম পুরুষ ভগবানের সংগে তাঁর নিত্য, অবিচ্ছেদ্য, প্রেমময়, সম্পর্কের পুনঃস্থাপন করতে হবে।
৩১। অহংকার কয় প্রকার ও কি কি? বর্ননা কর।
উঃ অহংকার দুই প্রকার - (১) সত্য অহংকার, (২) মিথ্যা অহংকার। আমি চিন্ময় আত্মা, কৃষ্ণের নিত্যদাস, এরকম যে ভাব নিয়ে কৃষ্ণের প্রীতিবিধানের উদ্দেশ্যে কর্ম করা হয়, সেই ভাবকে বলা হয় সত্য অহংকার। আমি এই জড় শরীর এবং আমার শরীরের প্রীতিবিধানের জন্য আমি কর্ম করব এরকম অহংকারকে বলা হয় মিথ্যা অহংকার।
৩২। প্রেয় ও শ্রেয় কি? জীবনে প্রেয় লাভ করা না শ্রেয় লাভ করা শ্রেষ্ঠ?
উঃ যা অল্প সময়ের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া যায় কিন্তু ক্ষণস্থায়ী এবং অন্তিমে দুঃখজনক তাকে বলা হয় প্রেয়।
যা লাভ করা পরিশ্রম সাপেক্ষ, কিন্তু চিরস্থায়ী এবং সুখদায়ক, তাকে বলা হয় শ্রেয়।
আমাদের জীবনে শ্রেয় লাভ করাই শ্রেষ্ঠ বা উচিত।
৩৩। জীবনে প্রকৃত শ্রেয় কি? বর্ণনা কর।
উঃ জীবনে প্রকৃত শ্রেয় হচ্ছে নিজের স্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দে অহৈতুকী ভক্তিভাবে তাঁর সেবায় যুক্ত হওয়া।
৩৪। ভগবান কে?
উঃ শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন ভগবান, যাঁর থেকে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। যিনি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের পালন করেন এবং সংহারের কারণ হন, তিনিই হচ্ছেন ভগবান।
৩৫। ভগবান শব্দের অর্থ কি?
উঃ যাহার মধ্যে সমগ্র ঐশ্বর্য্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি গুণ পূর্ণমাত্রায় বর্তমান তাকে বলা হয় ভগবান।
৩৬। ভগবান সাকার না নিরাকার?
উঃ ভগবান সাকার; তাঁর রূপ রয়েছে, তবে তা জড় নয়, অপ্রাকৃত। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সচ্ছিদানন্দ বিগ্রহ, তিনি নিত্য, জ্ঞান ও আনন্দময় মূর্তিবিশিষ্ট।
৩৭। কয় প্রকার যোগী আছেন?
উঃ যোগী চার প্রকার - কর্মযোগী, জ্ঞানযোগী, ধ্যানযোগী ও ভক্তিযোগী।
৩৮। কোন প্রকার যোগী নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন?
উঃ জ্ঞানযোগী নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন।
৩৯। কোন প্রকার যোগী হৃদয়ে পরমাত্মার ধ্যান উপাসনা করেন?
উঃ অষ্টাঙ্গ যোগী বা ধ্যান যোগী ধ্যানের মাধ্যমে পরমাত্মার উপাসনা করিয়া থাকেন।
৪০। কোন প্রকার যোগী সরাসরি ভগবানের উপাসনা করেন?
উঃ ভক্তিযোগ অবলম্বনকারী ভগবানের ভক্তরাই ভগবানের উপাসনা করেন।
৪১। ভগবান যে আছেন তার প্রমাণ কি?
উঃ ভগবানের অস্তিত্বের প্রমাণ লাভ করবার জন্য আমাদের শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। শাস্ত্র থেকে আমরা বুঝতে পারব যে ভগবান আছেন। ভগবান হচ্ছেন তিনি যিনি এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের কারণ। যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ জগতে আমরা দেখতে পাচ্ছি - একটি বাড়ী আপনা থেকে তৈরী হয়ে যায় না। বাড়ীটি তৈরী করার জন্য কোন ইঞ্জিনিয়ার বুদ্ধি দিয়ে থাকে এবং মিস্ত্রিরা ইট, বালি, পাথর দিয়ে বাড়ীটি তৈরী করে থাকে। ঠিক সেই রকম এই বিশ্বব্রহ্মান্ড আপনা থেকেই এমন সুশৃঙ্খল হয়ে যায় না। সৃষ্টির পেছনে কারো না কারো হাত আছে। যিনি বুদ্ধি প্রদান করেছেন, এই সমস্ত উপাদান প্রদান করেছেন এবং যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন ভগবান।
৪২। ভগবানের সংগে জীবের সম্পর্ক কি?
উঃ ভগবানের সংগে জীবের সম্পর্ক হচ্ছে ভগবান নিত্যপ্রভু এবং জীব তাঁর নিত্যদাস।
৪৩। ভগবানের সংগে জড় জগতের সম্পর্ক কি?
উঃ জড়জগৎ হচ্ছে ভগবানের অনুৎকৃষ্টা বহিরঙ্গা শক্তির থেকে উৎপন্ন।
৪৪। ভগবান কেন জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন?
উঃ প্রথম কারণঃ এই জড় জগৎ হচ্ছে সমস্ত চিন্ময় সৃষ্টির একাংশে অবস্থিত ক্ষুদ্র কারাগার সদৃশ। তাই যারা ভগবানের প্রদত্ত নিয়ম ভঙ্গ করে, তাদেরকে এই জড় জগতে আসতে হয়। এখানে বহিরঙ্গা শক্তি দুর্গাদেবী জড় জগৎরূপ দুর্গের দেখাশুনা করেন এবং ত্রিতাপ ক্লেশ দিয়ে জীবকে শাসন করে শিক্ষা প্রদান করে থাকেন।
দ্বিতীয় কারণঃ ভগবান এই জড় জগৎ এইজন্য সৃষ্টি করেছেন যে, জীব যেন তার মিথ্যা প্রভুত্ব করার আকাঙ্ক্ষা ও ভোগবাসনা পরিত্যাগ করে ভগবদ্ভজনের মাধ্যমে ভগবদ্ধামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে আবার ফিরে যেতে পারে।
৪৫। ভগবানের সৃষ্ট জীব দুঃখ কষ্ট পায় কেন?
উঃ কৃষ্ণ ভুলি সেই জীব অনাদি বহির্মুখ। অতএব মায়া তারে দেয় সংসার দুঃখ। (চৈঃ চঃ মধ্য ২০/১১৭)
এই জড় জগতে দুঃখ কষ্ট পাওয়ার কারণ হচ্ছে আমরা পরমেশ্বর ভগবানকে বিস্মৃত হয়েছি।
৪৬। আত্মা কিভাবে প্রসন্নতা লাভ করতে পারে?
উঃ যখন জীব তার নিত্য, শাশ্বত, ভালোবাসার বস্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সংগে তার সেই লুপ্ত সম্পর্ককে আবার পুনঃস্থাপন করে তাঁর প্রেমময়ী সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারে তখন সে প্রসন্নতা লাভ করে।
৪৭। আমি যে আত্মা তার প্রমাণ কি?
উঃ 'আমি' এই 'শরীর' নই, আমি মন নই, আমি বুদ্ধি নই, আমি আত্মা। এর প্রমাণ আমরা ভগবদগীতা আদি শাস্ত্র গ্রন্থ থেকে পেয়ে থাকি। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, "জীবের আসল স্বরূপ হচ্ছে সে চিন্ময় আত্মা, এবং আমার নিত্য সনাতন অংশ"। কেউ যদি একটি শিশুকে দুই বছর বা এক বছর বয়সে তাকে দেখে এবং ৪০ বছর বয়সে তাকে দেখে তাহলে সে দেখবে যে ইতিমধ্যে শিশুটির রূপ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে, তার দেহের, মনের, বুদ্ধির পরিবর্তন হয়েছে। তবুও সেই লোকটি একই লোক অর্থাৎ তার মধ্যে একটিই সত্তা রয়েছে, যার পরিবর্তন হয় না। সেইটিই হচ্ছে আত্মা, সেটিই হচ্ছে জীবের আসল স্বরূপ, ব্যক্তিত্বের কেন্দ্র। আর একটি প্রমাণ হচ্ছে - ধরুন আপনার দিদিমা বাড়ীতে শুয়ে আছেন দেখে আপনি বাজার করতে গিয়েছেন। বাজারে আপনি শুনতে পেলেন যে আপনার দিদিমা মারা গেছেন। বাড়ী ফিরে এসে দেখছেন বাজার যাওয়ার আগে দিদিমা যেভাবে খাটের উপর শুয়ে ছিলেন এখনও ঠিক সেই রকম ভাবেই শুয়ে আছেন এবং তাঁর চার পাশে ঘিরে আপনার বাবা বলছেন, "ও আমার মা চলে গেলে" - ভাই বলছে, "দিদিমা চলে গেল" ইত্যাদি। আপনি দেখতে পাচ্ছেন আপনার দিদিমা খাটে শুয়ে আছে, আবার সবাই চিৎকার করছে, 'মা চলে গেল' দিদিমা চলে গেল' ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে - কে চলে গেল? সেইটাই হচ্ছে আত্মা। আত্মা চলে গেলে শরীর জড় অবস্থা প্রাপ্ত হয়। শরীরে কোন চেতনার লক্ষণ দেখা যায় না, অর্থাৎ শরীরটা অচেতন হয়ে যায়। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আমি এই 'দেহ' নই 'মন' নই- - আমি হচ্ছি চিন্ময় 'আত্মা'।
৪৮। প্রকৃতির তিনটি গুণ কি কি?
উঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ -- সত্ত্বগুণ, রজগুণ এবং তমোগুণ।
৪৯। ভগবান কোথায় থাকেন?
উঃ এই জড় জগতের বাইরে চিন্ময় জগৎ বা বৈকুন্ঠলোক আছে, যেখানে অনেক গ্রহলোক আছে। বৈকুন্ঠ, দ্বারকা, বৃন্দাবন ইত্যাদি ধামে ভগবান বিভিন্ন ভগবৎ - স্বরূপে অবস্থান করেন। একই সংগে তিনি পরমাত্মা রূপে সর্বত্র প্রত্যেকটি অনুপরমাণু ও প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়েও বাস করে থাকেন।
৫০। কে প্রকৃত ভগবান এবং কে নকল বা ভন্ড ভগবান তা জানব কি করে?
উঃ শাস্ত্রের মাধ্যমে ভগবানের আসল স্বরূপ জানা যায়।
৫১। ভগবান কেন এই জড় জগতে অবতীর্ণ হন?
উঃ ভগবান এই জড় জগতে অবতীর্ণ হন সাধুদেরকে পরিত্রাণ করবার জন্য, দুস্কৃতদের বিনাশ করবার এবং ধর্ম স্থাপন করবার জন্য। বিশেষ করে ভগবান এই জগতে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর দিব্য লীলাবিলাস করে থাকেন, যে লীলার কথা শ্রবণ করে বদ্ধ জীব জড় জগতের বন্ধন মুক্ত হয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারে।
৫২। শ্রীকৃষ্ণ ও বিষ্ণুর মধ্যে কি পার্থক্য আছে?
উঃ শ্রীকৃষ্ণ এবং বিষ্ণুর মধ্যে তত্ত্বতঃ কোন পার্থক্য নেই। তবে শ্রীকৃষ্ণ গোলক বৃন্দাবনে থাকেন এবং শ্রীবিষ্ণু বৈকুণ্ঠধামে বিরাজ করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপে গোলক বৃন্দাবনে মাধুর্যরস আস্বাদন করে থাকেন এবং তিনিই বৈকুণ্ঠে শ্রীবিষ্ণুরূপে ঐশ্বর্যরস আস্বাদন করে থাকেন। ঠিক যেমন একটি লোক যখন আদালতে বিচারক তখন সে খুব গম্ভীর, সবাই তাকে সম্মান করেন এবং তিনি যা আদেশ দেন সবাই তা পালন করতে বাধ্য থাকেন। কিন্তু সেই লোক যখন গৃহে ফিরে আসেন তখন তাঁর নাত নাতনিরা তাঁর উপরে উঠে নানা বায়না করে এবং তাঁর সংগে খেলাধুলা করে। সেখানে কোন সম্ভ্রমের ভাব থাকে না। ঠিক তদ্রূপ ভগবান বিষ্ণুরূপে যখন বৈকুণ্ঠে থাকেন তখন তিনি তাঁর ভক্তদের সংগে সম্ভ্রম ভাবে অবস্থান করেন। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সংগে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হতে গেলে শুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম বিকশিত করে গোলক বৃন্দাবনে যেতে হয়। সেখানে ভগবানের সংগে জীব সখ্য রসে, বাৎসল্য রসে কিংবা মধুর রসে সম্পর্ক স্থাপন করে ভগবানের আরও ঘনিষ্ঠ ও নিকটতম হয়ে প্রেমময় সেবাসুখ আস্বাদন করতে পারেন।
৫৩। ভগবানকে লাভ করার যথাযথ উপায় কি?
উঃ শাস্ত্রে বিভিন্ন উপায়ে বর্ণনা করা হয়েছে - যথা কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ, কিন্তু প্রকৃত-পক্ষে ভগবানকে লাভ করার একমাত্র সহজ উপায় হচ্ছে ভক্তিযোগ। ভক্তির দ্বারাই কেবল ভগবানকে লাভ করা যায়।
৫৪। ভক্তি কি ভাবে লাভ করা যায়?
উঃ "ভগদ্ভক্ত সঙ্গেন উপজায়তে" - - অর্থাৎ ভগবানের ভক্তের সঙ্গ করার মাধ্যমে ভগদ্ভক্তি লাভ করা যায়।
৫৫। নবধা ভক্তি কি কি?
উঃ শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, বন্দন, অর্চন, পাদসেবন, দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদন।
৫৬। কে কোন প্রকার ভক্তি অবলম্বন করে ভগবানকে প্রাপ্ত হয়েছেন?
উঃ শ্রবণে পরীক্ষিৎ মহারাজ, কীর্তনে শুকদেব গোস্বামী, স্মরণে প্রহ্লাদ মহারাজ, পাদসেবনে লক্ষ্মী, বন্দনে অত্রুর, অর্চনে পৃথু মহারাজ, দাস্যে হনুমান, সখ্যে অর্জুন, এবং আত্মনিবেদনে বলি মহারাজ ভগবানকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
৫৭। কাম ও প্রেম কাকে বলে?
উঃ আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি বাঞ্ছা -- তারে বলে 'কাম'।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে 'প্রেম' নাম।
(চৈঃ চঃ আঃ ৪/১৬৫)
নিজের ইন্দ্রিয়ের বিধানের তৃপ্তি জন্য যে বাসনা তাকে বলে কাম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধানের জন্য যে বাসনা তাকে বলে প্রেম। জীবের অন্তরে রয়েছে শুদ্ধ ভগবৎ প্রেম। জীব যখন জড় জগতে পতিত হয়, তখন তাঁর শুদ্ধ ভগবৎ প্রেম বিকৃত কামে পরিণত হয়।
৫৮। জীবের দুঃখের মূল কারণ কি?
উঃ জীবের দুঃখের মূল কারণ কৃষ্ণবিস্মৃতি। জীব যখন কৃষ্ণের সংগে তার নিত্য সম্পর্কের কথা ভুলে যায়, তখন তার নিত্য স্বরূপ চিন্ময় আত্মা, এ বিষয়ে বিস্মৃতির ফলে এবং এই দেহকে আত্মবুদ্ধি করার ফলে এ জগতে জীব নিয়ত দুঃখে জর্জরিত হয়।
৫৯। অষ্টাঙ্গ যোগ কি?
উঃ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি। এই আট প্রকার যোগ পদ্ধতিকে বলা হয় অষ্টাঙ্গযোগ।
৬০। অষ্টসিদ্ধি কি কি?
উঃ অণিমা, মহিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিত্বা, বশিতা ও কামবশয়িতা।
৬১। ভগবানের নিরাকার, নির্বিশেষ বিভাগ কাকে বলে?
উঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিত্যকাল গোলক বৃন্দাবনে অবস্থান করেন। তাঁর দেহ থেকে নির্গত ব্রহ্মজ্যোতি সমস্ত পরব্যোমে অর্থাৎ চিদাকাশে স্থিত চিন্ময় জগৎকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। সেই জ্যোতিকে বলা হয় নির্বিশেষ বিভাগ।
৬২। যোগীরা হৃদয়ে কার ধ্যান করেন?
উঃ যোগীরা হৃদয়ে পরমাত্মারূপী নারায়ণকে ধ্যান করেন।
৬৩। জ্ঞানযোগী কাকে বলে?
উঃ যাঁরা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করে ব্রহ্মে লীন হওয়ার জন্য প্রয়াস করে, তাদেরকে জ্ঞান যোগী বলা হয়।
৬৪। ধ্যানযোগী কাকে বলে?
উঃ যাঁরা পরমাত্মাকে হৃদয়ে ধ্যান করে তাঁদেরকে ধ্যানযোগী বলে।
৬৫। ভক্তিযোগী কাকে বলে?
উঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানই যাঁর একমাত্র অভিলাষ, যিনি অনন্যচিত্তে প্রগাঢ় প্রেমের সংগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিমূলক সেবায় যুক্ত থাকেন, তিনিই ভক্তিযোগী।৬৬। জ্ঞানী, যোগী ও ভক্তের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? এবং কেন?
উঃ ভক্তই সবথেকে শ্রেষ্ঠ। জ্ঞানীরা ভগবানের অব্যক্ত নিরাকার রূপকে উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু ভগবানকে প্রাপ্ত হয় না। যোগীরা ভগবানের আংশিক প্রকাশ পরমাত্মা রূপে ভগবানকে হৃদয়ে দর্শন করে থাকে কিন্তু ভগবানের সংগে ভাবের ততটা আদান প্রদান করতে পারে না। ভগবানের ভক্ত ভগবানের সব থেকে নিকটতম হয়ে ভগবদ্ধামে প্রবেশ করে প্রত্যক্ষভাবে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। তাঁর প্রেমময়ী ভক্তিমূলক সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারে তাই ভক্ত ভগবানের অত্যন্ত প্রিয়। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এজন্য ভক্তের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন।
৬৭। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-কর্ম ও জীবের জন্ম-কর্মের মধ্যে পার্থক্য কি?
উঃ শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-কর্ম দিব্য, শ্রীকৃষ্ণ ত্রিগুণাতীত তাঁকে কর্মফল ভোগ করতে হয় না। শ্রীকৃষ্ণ স্ব-ইচ্ছায় জীব উদ্ধারের জন্য এই জগতে আবির্ভূত হন। কিন্তু জীবের জন্ম তাঁর অজ্ঞানতাবশতঃ হয়ে থাকে, সে তার কর্মফল ভোগ করবার জন্য একটি নির্দিষ্ট শরীর গ্রহণ করতে বাধ্য থাকে। জীবকে এই জগতে জন্ম গ্রহণ করতে হলে পুরুষের শুত্রুকে আশ্রয় করে তাঁর কর্ম অনুসারে সেই প্রকার যোনী লাভ করতে হয়। জীবের কর্ম ত্রিগুণ ও মায়ার দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। সেইজন্য জীবকে তার কর্মফলভোগ করতে হয়। জীবের সমস্ত কর্ম ভগবানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
৬৮। সমাজের যথার্থ কল্যাণ কিভাবে সাধিত হবে?
উঃ সমাজের সমস্ত মানুষকে যদি কৃষ্ণ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যায় তাহলেই সমাজের যথার্থ কল্যাণ সাধিত হবে। কারণ কৃষ্ণচেতনাই চেতনার উচ্চতম স্তর।
৬৯। পরম ব্রহ্ম সাকার না নিরাকার?
উঃ পরম ব্রহ্ম সাকার এবং নিরাকার উভয়ই। পরম ব্রহ্মের আসল স্বরূপ সাকার রূপে তিনি গোলক বৃন্দাবনে অবস্থান করেন এবং তাঁর শরীর হতে নির্গত জ্যোতি -- যা চিন্ময় জগৎ কে উদ্ভাসিত করে বিদ্যমান তাঁকে তাঁর নিরাকার রূপ বলা হয়।
৭০। প্রত্যেকটি জীব কি ভগবান?
উঃ জীব হচ্ছে ভগবানের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ, ভগবান নয়।
৭১। জীব সাধন ভজন করে কোনদিন কি সাধনার সিদ্ধি স্বরূপ ভগবান হতে পারে?
উঃ জীব ভগবানের নিত্য দাস, নিত্য অংশ, অংশ কোন দিন পূর্ণ হতে পারে না, অংশের কাজ পূর্ণের সেবা করা সেই জন্য জীব কখনই ভগবান হতে পারে না।
৭২। জীব ও ভগবানের মধ্যে সম্বন্ধ কি?
উঃ জীব ভগবানের নিত্য দাস।
৭৩। যে কোন দেবতাকে পূজা করে কি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা যায়?
উঃ যে দেবতাকে আমরা পূজা করব, আমাদের দেহান্তে সেই দেবলোকেই আমরা যাবো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে হলে অবস্যই ভগবান মুকুন্দের শরণাগত হয়ে তাঁর সেবা করতে হবে। তবেই ভগবানকে লাভ করা যাবে।
৭৪। শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করবার জন্য কলিযুগে কোন পন্থা সর্বোৎকৃষ্ট?
উঃ শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করবার জন্য কলিযুগে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' কীর্তন করাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
৭৫। ভগবানের ভজনা করলে পিতামাতার সেবা হয় কি?
উঃ ভগবানের ভজনা করলে পিতামাতারও সেবা হয়। কেবলমাত্র পিতামাতা নয়, মুনি ঋষি, দেবতা সকলের সেবা হয়ে থাকে। যেহেতু ভগবানের কাছ থেকে সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে তাই, ভগবান হচ্ছেন সবকিছুর মূল। যে ভাবে গাছের গোড়ায় জল দিলে তার শাখা প্রশাখা, পত্র, পুষ্প সবই পরিপুষ্ট হয় এবং উদরকে খাদ্য দিলে যেমন সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি পুষ্ট হয়, ঠিক সেইরূপ ভগবান সন্তুষ্ট হলে সবাই তুষ্ট হন। "যন্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্ট"।
৭৬। মানুষের কেমন খাদ্য আহার করা কর্তব্য?
উঃ মানুষের জীবনকে সফল করতে হলে ভগবানের প্রসাদই ভোজন করা উচিত। কেন না যা আমরা ভোজন করি সেই খাদ্য ভগবানকে অর্পণ করলে, তা প্রসাদে পরিণত হয়। প্রসাদ ভোজনের ফলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। নচেৎ আমরা পাপ ভক্ষণ করি।
৭৭। ভগবানকে কি প্রকার খাদ্য নিবেদন করা যায়?
উঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন "পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং" - - 'ভক্তি সহকারে আমাকে পত্র পুষ্প, ফল, জল প্রভৃতি অর্পণ করলে আমি তা গ্রহণ করে থাকি।' এভাবে তিনি নিরামিষ খাদ্যবস্তুর কথা বলেছেন, মাছ, মাংস প্রভৃতির কথা বলেন নি।
৭৮। ভগবানের কাছে কি প্রার্থনা করা উচিত?
উঃ ভগবানের কাছে আমাদের প্রার্থনা করা উচিত যে আমরা যেন তাঁর শ্রীচরণে অহৈতুকী ভক্তি লাভ করতে পারি। তাঁর শ্রীচরণে সেবা করার সুযোগ যেন জন্মজন্মান্তরে লাভ করতে পারি।
৭৯। শ্রীকৃষ্ণ ও নবদ্বীপ ধামে অবতীর্ণ শ্রীচৈতন্য দেবের মধ্যে কি পার্থক্য আছে?
উঃ 'ব্রজেন্দ্রনন্দন যেই শচীসূত হইল সেই।
বলরাম হইল নিতাই।।'
শ্রীকৃষ্ণই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। তবে শ্রীকৃষ্ণ শুদ্ধভক্তি শিক্ষা দেবার জন্য ও স্বয়ং ভক্তিরসের অপূর্ব মাধুর্য আস্বাদনের জন্য ভক্তরূপে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।
'শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য "রাধাকৃষ্ণ" নহে অন্য।'
ভক্ত ভগবানের সেবা করে কি প্রকারের আনন্দ লাভ করে তা জানবার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পরম শ্রেষ্ঠ ভক্ত শ্রীমতী রাধারানীর অঙ্গকান্তি ও ভাবকে গ্রহণ করে শ্রীচৈতন্যরূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
৮০। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অবতীর্ণ হয়ে কি প্রচার করেছিলেন?
উঃ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অবতীর্ণ হয়ে 'হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র' কীর্তনের মাধ্যমে কিভাবে কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা যায় তা প্রদর্শন ও প্রচার করেছিলেন।
৮১। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কোন ভবিষ্যদ্বাণীকে প্রভুপাদ বাস্তবে রূপায়িত করেছেন?
উঃ পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম।
সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম।।
এই ভবিষ্যদ্বাণীকে শ্রীল প্রভুপাদ বাস্তবে রূপায়িত করে সারা বিশ্বে এই হরিনাম প্রচার করেছেন।
৮২। ভগবানের মায়াশক্তিকে কত ভাগে বিভক্ত করা যায়? সেগুলি কি এবং কোথায় কাজ করে?
উঃ ভগবানের মায়াশক্তি দু-প্রকারের -- ১। যোগমায়া, ২। মহামায়া। অন্তরঙ্গা যোগমায়া শক্তির দ্বারা চিন্ময় জগৎ পরিচালিত হয়। বহিরঙ্গা মহামায়া শক্তির দ্বারা জড় জগৎ পরিচালিত হয়।
৮৩। ভগবানের সমস্ত শক্তিকে কয় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে? সেগুলি কি কি?
উঃ ভগবানের অনন্ত শক্তিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে-- ১। অন্তরঙ্গা শক্তি ২। বহিরঙ্গা শক্তি এবং ৩। তটস্থা শক্তি।
৮৪। জীব ভগবানের কোন শক্তি?
উঃ জীব ভগবানের তটস্থা শক্তি।
৮৫। জড়জগতে বদ্ধ জীব ভগবানের কোন শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়?
উঃ জড়জগতে বদ্ধ জীব ভগবানের বহিরঙ্গা ত্রিগুণাত্মিকা মায়া শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়।
৮৬। চিন্ময় জগতের সবকিছু ভগবানের কোন শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়?
উঃ চিন্ময় জগতের সবকিছু ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা পরিচালিত হয়।
৮৭। মানুষের ছয়টি প্রধান শত্রু বা ষড়রিপু কি?
উঃ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য-- এই ছয়টি হচ্ছে ষড়রিপু--মানুষের প্রধান শত্রু।
৮৮। ষড় রিপু কি ভাবে দমন করা যায়?
উঃ কায়, মন ও বাক্য দ্বারা ভগবানের সেবা করলে, হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র নিষ্ঠা সহকারে কীর্তন করলে, ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ ভোজন করলে ষড়রিপু সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তের তত্ত্বাবধানে ভক্তিসেবা অনুশীলনই একমাত্র উপায়।
৮৯। কর্মফল থেকে কি ভাবে মুক্তি লাভ করা যায়?
উঃ আমরা যা কর্ম করি সেই সমস্ত কর্মের ফল যদি ভগবানকে অর্পণ করি তাহলে আমরা কর্মবন্ধন বা কর্মফল থেকে মুক্তি পেতে পারব।
৯০। ভক্তির সংজ্ঞা কি?
উঃ "হৃষিকেন হৃষিকেষ সেবনং ভক্তিরুচ্যতে"...... আমার ইন্দ্রিয় দিয়ে ইন্দ্রিয়ের অধিপতি ভগবানের সেবা করাকেই ভক্তি বলা হয়।
৯১। সমস্ত ইন্দ্রিয়গণের প্রভাবকে জয় করবার উপায় কি?
উঃ সমস্ত ইন্দ্রিয়কে কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করার মাধ্যমে তাদের জয় করা যায়। ইন্দ্রিয় স্বভাবতঃ সবসময় বিষয় ভোগের দিকে ধাবিত হয়। সেই ইন্দ্রিয় সকলকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবারূপ উন্নত স্বাদ প্রদান করলে তারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
ঠিক যেভাবে জিহ্বাকে জয় করবার উপায় কৃষ্ণপ্রসাদ সেবা, কৃষ্ণকথা আলোচনা, কর্ণ দিয়ে কৃষ্ণের গুণ শ্রবণ এবং হরিকথা শ্রবণ। নাসিকা দিয়ে কৃষ্ণের চরণে অর্পিত তুলসীর ঘ্রাণ গ্রহণ করা, চক্ষু দিয়ে শ্রীবিগ্রহকে দর্শন করা, হাত দিয়ে মন্দির মার্জন করা।
৯২। ভগবানের তুষ্টি বিধান করলে সমস্ত জগৎ সন্তুষ্ট হবে কি?
উঃ হ্যাঁ যস্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্ট..........
যেহেতু এই সমগ্র জগতের সৃষ্টিকর্তা ভগবান সেই হেতু ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানে সমগ্র জগৎ তুষ্ট হবে।
৯৩। যথার্থ জ্ঞান কাকে বলে?
উঃ আমি এই 'শরীর' নই, আমি চিন্ময় 'আত্মা'- - ভগবানের নিত্য অংশ। এইটি জানাকে বলা হয় যথার্থ জ্ঞান।
৯৪। আত্মোপলব্ধির প্রথম সোপান কি?
উঃ আমি এই দেহ নই, আমি হচ্ছি চিন্ময় আত্মা এইটিকে জানা।
৯৫। ত্রিগুনাত্মিকা জড়া প্রকৃতির কার্য কি?
উঃ এর প্রভাবে জীব এই জড় জগতের সমস্ত কার্য সম্পাদন করে।
৯৬। গুণের প্রভাব থেকে কিভাবে মুক্তি লাভ করা যায়?
উঃ গুণের প্রভাবে আমরা যা কর্ম করি সেই কর্ম যদি ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্পিত হয়, তাহলে আস্তে আস্তে আমরা গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারি।
৯৭। চারটি যুগের নাম কি?
উঃ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি।
৯৮। বিভিন্ন যুগে ভগবানকে লাভ করবার উপায় কি?
উঃ সত্যযুগে ভগবানকে লাভ করবার উপায় হচ্ছে ধ্যান। ত্রেতাযুগে -- যজ্ঞ, দ্বাপর যুগে -- অর্চনা, আর কলিযুগে হরিনাম সংকীর্তন।
৯৯
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আলোকে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বজিজ্ঞাসা সম্পর্কে আরো জানতে নিচে ক্লিক করুন
সনাতন ধর্ম সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
আরো জানুনঃ
কেন প্রসাদভোজী হবেন? সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র (বেদ,সংহিতা, মহাভারত, গীতা,ভাগবত,পুরাণ,উপনিষদ) থেকে প্রমান দেওয়া হলো...
চার যুগ-সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর ও কলির সময় পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
0 মন্তব্যসমূহ