শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা

 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অধ্যায় ভিত্তিক সারসংক্ষেপঃ

 

 অর্জুন বিষাদ-যোগ

 কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে সেনা-পর্যবেক্ষণ: রণাঙ্গনে প্রতীক্ষমাণ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে, মহাযোদ্ধা অর্জুন উভয় পক্ষের সৈন্যসজ্জার মধ্যে সমবেত তার অতি নিকট আত্মীয়-পরিজন, আচার্যবর্গ ও বন্ধু-বান্ধবদের সকলকে যুদ্ধে প্রস্তুত হতে এবং জীবন বিসর্জনে উন্মুখ হয়ে থাকতে দেখেন। শোকে ও দুঃখে তার মন মোহাচ্ছন্ন হল এবং তিনি যুদ্ধ করার সংকল্প পরিত্যাগ করেন।  
 

সাংখ্য যোগ

কৃষ্ণের কাছে তার শিষ্যরূপে অর্জুন আত্মসমর্পণ করেন এবং অনিত্য জড় দেহ ও শাশ্বত চিন্ময় আত্মার মূলগত পার্থক্য নির্ণয়ের মাধ্যমে অর্জুনকে কৃষ্ণ উপদেশ প্রদান করতে শুরু করেন। দেহান্তর প্রক্রিয়া, পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ সেবার প্রকৃতি এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ মানুষের বৈশিষ্ট্যাদি সম্পর্কে কৃষ্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।
 

কর্ম যোগ

এই জড় জগতে প্রত্যেককেই কোনও ধরনের কাজে নিযুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু কর্ম সকল মানুষকে এই জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করতেও পারে, আবার তা থেকে মুক্ত করে দিতেও পারে। স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেকে, পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাজের মাধ্যমে, মানুষ তার কাজের প্রতিক্রিয়া জনিত কর্মফলের বিধিনিয়ম থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং আত্মতত্ত্ব ও পরমতত্ত্ব দিব্যজ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়।  

 

জ্ঞান যোগ 

আত্মার চিন্ময় তত্ত্ব, ভগবৎ-তত্ত্ব এবং ভগবান ও আত্মার সম্পর্ক -এই সব অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান বিশুদ্ধ ও মুক্তিপ্রদায়ী। এই প্রকার জ্ঞান হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভক্তিমূলক কর্মের (কর্মযোগ) ফলস্বরূপ। পরমেশ্বর ভগবান গীতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, জড় জগতে যুগে যুগে তার অবতরণের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ গুরুর সান্নিধ্য লাভের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করেছেন।

সন্ন্যাস-যোগ

বহিঃবিচারে সকল কর্তব্যকর্ম সাধন করলেও সেগুলির কর্মফল পরিত্যাগ করার মাধ্যমে, জ্ঞানবান ব্যক্তি পারমার্থিক জ্ঞানতত্ত্বের অগ্নিস্পর্শে পরিশুদ্ধি লাভ করে থাকেন, ফলে শান্তি, নিরাসক্তি, চিন্ময় অন্তর্দৃষ্টি এবং শুদ্ধ আনন্দ লাভ করেন।

ধ্যানযোগ

নিয়মতান্ত্রিক ধ্যানচর্চার মাধ্যমে অষ্টাঙ্গযোগ অনুশীলন মন ও ইন্দ্রিয় আদি দমন করে এবং অন্তর্যামী পরমাত্মার চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট রাখে।এই অনুশীলনের পরিণামে পরমেশ্বরের পূর্ণ ভাবনারূপ সমাধি অর্জিত হয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, সর্বকারণের পরম কারণ এবং জড় ও চিন্ময় সর্ববিষয়ের প্রাণশক্তি। উন্নত জীবাত্মাগণ ভক্তি ভরে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকেন, পক্ষান্তরে অধার্মিক জীবাত্মারা অন্যান্য বিষয়ের ভজনায় তাদের মন বিক্ষিপ্ত করে থাকে।

 অক্ষরব্রহ্ম-যোগ


আজীবন কৃষ্ণের চিন্তার মাধ্যমে এবং বিশেষ করে মৃত্যুকালে তাকে স্মরণ করে, মানুষ জড় জগতের ঊর্ধ্বে ভগবানের পরম ধাম লাভ করতে পারে।

 রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগ

কৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং পরমারাধ্য বিষয়। অপ্রাকৃত ভগবত-সেবার মাধ্যমে জীবাত্মা মাত্রই তার সাথে নিত্য সম্বন্ধযুক্ত। মানুষের শুদ্ধ ভক্তি পুনরুজ্জীবিত করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব।
 

বিভূতি যোগ

জড় জগতের বা চিন্ময় জগতের শৌর্য, শ্রী, আড়ম্বর, উতকরশ-সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় কৃষ্ণের দিব্য শক্তি ও পরম ঐশ্বর্যাবলির আংশিক প্রকাশ মাত্র অভিব্যক্ত হয়ে আছে। সর্বকারণের পরম কারণ, সর্ববিষয়ের আশ্রয় ও সারাতিসার রূপে কৃষ্ণ সর্বজীবেরই পরমারাধ্য বিষয়।

বিশ্বরূপ দর্শন যোগ

 কৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দান করেন এবং সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষক তার অনন্ত বিশ্বরূপ প্রকাশ করেন। এভাবেই তিনি তার দিব্যতত্ত্ব অবিসংবাদিতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কৃষ্ণ প্রতিপন্ন করেছেন যে, তার স্বীয় অপরূপ সৌন্দর্যময় মানবরূপী আকৃতিই ভগবানের আদিরূপ। একমাত্র শুদ্ধ ভগবত-সেবার মাধ্যমেই মানুষ এই রূপের উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম।

ভক্তিযোগ

চিম্নয় জগতের সর্বোত্তম প্রাপ্তি বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভের পক্ষে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণের উদ্দেশ্য শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। যারা এই পরম পন্থার বিকাশ সাধনে নিয়োজিত থাকেন, তারা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী হন।

ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ

দেহ, আত্মা এবং উভয়েরও ঊর্ধ্বে পরমাত্মার পার্থক্য যিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই এই জড় জগৎ থেকে মুক্তি লাভে সক্ষম হন।

গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ

সমস্ত দেহধারী জীবাত্মা মাত্রই সত্ত্ব, রজ ও তম—জড়া প্রকৃতির এই ত্রিগুণের নিয়ন্ত্রণাধীন। পরমেশ্বর কৃষ্ণ এই ত্রিগুণাবলির স্বরূপ, আমাদের ওপর সেগুলির ক্রিয়াকলাপ, মানুষ কিভাবে সেগুলিকে অতিক্রম করে এবং যে মানুষ অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত তার লক্ষণাবলী ব্যাখ্যা করেছেন।

পুরুষোত্তম-যোগ


বৈদিক জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে জড়-জাগতিক বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি লাভ এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে কৃষ্ণকে উপলব্ধি করা। যে মানুষ কৃষ্ণের পরম স্বরূপ উপলব্ধি করে, সে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ভক্তিমূলক সেবায় আত্মনিয়োগ করে।

দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ


যারা আসুরিক গুণগুলি অর্জন করে এবং শাস্ত্রবিধি অনুসরণ না করে যথেচ্ছভাবে জীবন যাপন করে থাকে, তারা হীনজন্ম ও ক্রমশ জাগতিক বন্ধনদশা লাভ করে। কিন্তু যারা দিব্য গুণাবলির অধিকারী এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসনাদি মেনে বিধিবদ্ধ জীবন যাপন করেন, তারা ক্রমান্বয়ে পারমার্থিক সিদ্ধিলাভ করেন।

শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ

জড় প্রকৃতির ত্রিগুণাবলির থেকে উদ্ভূত এবং সেগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রদ্ধা তিন ধরনের হয়ে থাকে। যাদের শ্রদ্ধা রাজসিক ও তামসিক, তারা নিতান্তই অনিত্য জড়-জাগতিক ফল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে, শাস্ত্রীয় অনুশাসন আদি মতে অনুষ্ঠিত সত্ত্বগুণময় কার্যাবলি হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং পরিণামে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শুদ্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধার পথে মানুষকে পরিচালিত করে ভক্তিভাব জাগ্রত করে তোলে।

মোক্ষযোগ

কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন ত্যাগের অর্থ এবং মানুষের ভাবনা ও কার্যকলাপের উপর প্রকৃতির গুণাবলির প্রতিক্রিয়াগুলি কেমন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ব্রহ্ম উপলব্ধি, ভগবদগীতার মাহাত্ম্য ও গীতার চরম উপসংহার- ধর্মের সর্বোচ্চ পন্থা হচ্ছে পরমেশ্বর কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, যার ফলে সর্বপাপ হতে মুক্তি লাভ হয়, সম্যক জ্ঞান-উপলব্ধি অর্জিত হয় এবং শাশ্বত চিন্ময় পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা যায়।
 


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার যেকোন অধ্যায় পাঠ করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন......


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ