এক পতির বহু পত্নীর কথা শোনা যায়। কিন্তু এক পত্নীর বহু পতি-তা কী করে সম্ভব! যেখানে সাধারণ সমাজেই এমন ঘটনাকে অন্যায্য বলে বিবেচনা করা হয়, সেখানে মহাভারতের মতো পবিত্র ধর্মগ্রন্থে কীভাবে এমন নীতিবহির্ভূত কাজকে অনুমোদন দেয়া হলো? মহাভারতের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চপান্ডবের বিবাহ নিয়ে প্রায়ই এমন মন্তব্য করতে শোনা যায়। যেখানে স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার ব্যাসদেব, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির উপস্থিত, সেখানে কী করে এমন একটি ঘৃণ্য কাজকে তাঁরা অনুমোদন করেন?
ভুঁইফোড় নিন্দুকেরা এর মর্মার্থ না বুঝেই যজ্ঞকুন্ড থেকে উত্থিত অগ্নির ন্যায় পবিত্র যজ্ঞসেনী দ্রোপদীর নির্মল চরিত্রে কালিমা লেপন করতে চায়, আর যারা এই ঘটনাকে অন্তঃকরণে স্থান দিতে পারেনি, তারা মনে মনে দ্রৌপদীর সতীত্বের প্রতি বারবার সংশয় আরোপ করে থাকে। হয়তবা কখনো কখনো কুন্তীদেবী, যুধিষ্ঠির, ব্যাসদেবের এমনকি কৃষ্ণকে পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী করা হয়। সামাজিক ও মানবীয় দৃষ্টীতে আপাতবিরোধী এই ঘটনায় কী এমন কারণ ছিল, যেখানে ধর্মসংস্থাপনকারী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, মহাভারতকার মহামুনি ব্যাসদেব ও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পর্যন্ত আপত্তি করেননি? চলুন, তবে জেনে নেয়া যাক এই রহস্যের আদ্যোপান্তে।
দ্রৌপদীর জন্ম
শকুনির কুচক্রে পান্ডবগণকে জতুগৃহে ভস্ম করার পরিকল্পনা বিদুরের সূক্ষ্ম দূরদর্শিতার প্রভাবে নস্যাৎ হলো। পান্ডবগণ মাতা কুন্তীসহ জতুগৃহ থেকে রক্ষা পেলেন। কিন্তু সেই সংবাদ শকুনি-দুর্যোদনাদির কর্ণগোচর না হওয়ায় কৌরবগণ হস্তিনাপুরে আনন্তবিলাসে মত্ত। জতুগৃহের অগ্নি থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পান্ডবগণ ব্রাহ্মণের চদ্মবেশে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে প্রতিশোধের অগ্নিতে প্রজ্বলিত দ্রুপদরাজ দ্রোণকে বধে সমর্থ পুত্র লাভের জন্য পুত্রেষ্টিযজ্ঞ করতে গিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন নামে মহাবলী পুত্র ও দ্রৌপদী নামে এক মহীয়সী কন্যা প্রাপ্ত হলেন। আশ্চর্য বিষয় হলো, দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যজ্ঞ থেকে উত্থিত হন। তাই এ সংসারের যোনিজাত সাধারণ মনুষ্যের সাথে তাদের তুলনা বাঞ্ছনীয় নয়। সুযোগ্যা পুত্র ও কন্যাকে পেয়ে দ্রুপদ রাজ মহা আনন্দিত।
ব্যাস কর্তৃক দ্রৌপদীর পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত বর্ণন
পান্ডবগণ তখন বকরাক্ষস বধের পর পাঞ্চাল রাজ্যের দিকে যাত্রা করলেন। তখন মহামুনি ব্যাসদেবের সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। তখন ব্যাসদেব প্রসঙ্গক্রমে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মবৃত্তান্ত পান্ডবগণকে শ্রবণ করান- "কোনো তপোবনে সর্বাঙ্গসুন্দরী সর্বগুণসম্পন্না এক ঋষিকন্যা বাস করতেন। সেই রমণী উপযুক্ত পতি লাভ না করতে পেরে অত্যন্ত ব্যথিতা হয়েছিলেন। তখন তিনি উপযুক্ত পতি লাভের ইচ্ছায় মহাদেবের তপস্যা করতে শুরু করেন।
তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তার সমক্ষে উপস্থিত হলে, মহীয়সী সর্বগুণসম্পন্ন পতিলাভের বর প্রার্থনা করেন। কিছুটা ইতস্তত হওয়ায় সেই রমণী পাঁচবার শিবের কাছে একই বর প্রার্থনা করেন। তখন শিব বললেন, "হে ঋষিকন্যা আমার বরের প্রভাবে তুমি পাঁচ পতি প্রাপ্ত হবে"। তখন ঋষিকন্যা বললেন,
"প্রভু আমি তো তোমার কাছে একপতি প্রার্থনা করেছি।" শিব বললেন, "কিন্তু একই প্রার্থনা পাঁচবার করেছ বিধায় তুমি পঞ্চস্বামী প্রাপ্ত হবে।" ব্যাসদেব বললেন, "সেই ঋষিকন্যাই এখন দ্রুপদের কন্যারূপে যজ্ঞ থেকে জাত হয়েছে। তাঁর সাথেই তোমাদের পাঁচ ভ্রাতার বিবাহ হবে। তাই তোমরা পাঞ্চালদেশ যাও।" একথা বলে ব্যাসদেব প্রস্থান করলেন। তারপর পান্ডবগণ দ্রুপদরাজ্যে এসে এক কুমারের গৃহে আশ্রয় নিলেন।
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর ও কুন্তীর নিকট গমন
দ্রুপদরাজ কন্যা দ্রোপদীকে বিবাহ দেয়ার অভিলাষ করলেন। কিন্তু অগ্নি থেকে উদ্ভুত কন্যাকে পাত্রস্থ করার জন্য অগ্নিধারণক্ষম উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন প্রয়োজন। তাই রাজা দ্রুপদ এক বিচিত্র ধনুর্বাণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে দ্রৌপদীর জন্য রাজা ও রাজপুত্রগণ আসতে লাগলেন।
পান্ডবগণও ব্রাহ্মণবেশে স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হলেন। বড় বড় ক্ষত্রিয় মহারথীগণ সেখানে দ্রুপদের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলেন, ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন সেখানে অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করে পাঞ্চালী দ্রৌপদীকে জয় করলেন। তারপর পান্ডবগণ দ্রৌপদীকে নিয়ে কুটিরে ফিরে এলেন। ভীম ও অর্জুন মাতা কুন্তীর উদ্দেশ্যে বললেন, "মা, আজ এক রমণীয় বস্তু ভিক্ষা লাভ করেছি।" কুন্তী দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা পান্ডবগণকে না দেখেই বললেন-
কুটীগতা সা ত্বনবেক্ষ্য পুত্রৌ প্রোবাচ ভুঙক্তেতি সমেত্য সর্ব্বে।
পশ্চাচ্চ কুন্তী প্রসমীক্ষ্য কৃষ্ণাং কষ্টং ময়া ভাষিতমিত্যুবাচ।।
(মহাভারত আদিপর্ব-১৮৪/২)
""কুন্তী ঘরের ভেতর ছিলেন বলে, ভীম ও অর্জুনকে না দেখেই বলে ফেললেন, "তোমরা সকলে মিলে তা ভোগ করো।" পরে তিনি দ্রৌপদীকে দেখে বললেন, "হায়! আমি বড়ই কষ্টের কথা বলে ফেলেছি।"
ভুঁইফোড় নিন্দুকেরা এর মর্মার্থ না বুঝেই যজ্ঞকুন্ড থেকে উত্থিত অগ্নির ন্যায় পবিত্র যজ্ঞসেনী দ্রোপদীর নির্মল চরিত্রে কালিমা লেপন করতে চায়, আর যারা এই ঘটনাকে অন্তঃকরণে স্থান দিতে পারেনি, তারা মনে মনে দ্রৌপদীর সতীত্বের প্রতি বারবার সংশয় আরোপ করে থাকে। হয়তবা কখনো কখনো কুন্তীদেবী, যুধিষ্ঠির, ব্যাসদেবের এমনকি কৃষ্ণকে পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী করা হয়। সামাজিক ও মানবীয় দৃষ্টীতে আপাতবিরোধী এই ঘটনায় কী এমন কারণ ছিল, যেখানে ধর্মসংস্থাপনকারী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, মহাভারতকার মহামুনি ব্যাসদেব ও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পর্যন্ত আপত্তি করেননি? চলুন, তবে জেনে নেয়া যাক এই রহস্যের আদ্যোপান্তে।
দ্রৌপদীর জন্ম
শকুনির কুচক্রে পান্ডবগণকে জতুগৃহে ভস্ম করার পরিকল্পনা বিদুরের সূক্ষ্ম দূরদর্শিতার প্রভাবে নস্যাৎ হলো। পান্ডবগণ মাতা কুন্তীসহ জতুগৃহ থেকে রক্ষা পেলেন। কিন্তু সেই সংবাদ শকুনি-দুর্যোদনাদির কর্ণগোচর না হওয়ায় কৌরবগণ হস্তিনাপুরে আনন্তবিলাসে মত্ত। জতুগৃহের অগ্নি থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পান্ডবগণ ব্রাহ্মণের চদ্মবেশে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে প্রতিশোধের অগ্নিতে প্রজ্বলিত দ্রুপদরাজ দ্রোণকে বধে সমর্থ পুত্র লাভের জন্য পুত্রেষ্টিযজ্ঞ করতে গিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন নামে মহাবলী পুত্র ও দ্রৌপদী নামে এক মহীয়সী কন্যা প্রাপ্ত হলেন। আশ্চর্য বিষয় হলো, দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যজ্ঞ থেকে উত্থিত হন। তাই এ সংসারের যোনিজাত সাধারণ মনুষ্যের সাথে তাদের তুলনা বাঞ্ছনীয় নয়। সুযোগ্যা পুত্র ও কন্যাকে পেয়ে দ্রুপদ রাজ মহা আনন্দিত।
ব্যাস কর্তৃক দ্রৌপদীর পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত বর্ণন
পান্ডবগণ তখন বকরাক্ষস বধের পর পাঞ্চাল রাজ্যের দিকে যাত্রা করলেন। তখন মহামুনি ব্যাসদেবের সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। তখন ব্যাসদেব প্রসঙ্গক্রমে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মবৃত্তান্ত পান্ডবগণকে শ্রবণ করান- "কোনো তপোবনে সর্বাঙ্গসুন্দরী সর্বগুণসম্পন্না এক ঋষিকন্যা বাস করতেন। সেই রমণী উপযুক্ত পতি লাভ না করতে পেরে অত্যন্ত ব্যথিতা হয়েছিলেন। তখন তিনি উপযুক্ত পতি লাভের ইচ্ছায় মহাদেবের তপস্যা করতে শুরু করেন।
তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তার সমক্ষে উপস্থিত হলে, মহীয়সী সর্বগুণসম্পন্ন পতিলাভের বর প্রার্থনা করেন। কিছুটা ইতস্তত হওয়ায় সেই রমণী পাঁচবার শিবের কাছে একই বর প্রার্থনা করেন। তখন শিব বললেন, "হে ঋষিকন্যা আমার বরের প্রভাবে তুমি পাঁচ পতি প্রাপ্ত হবে"। তখন ঋষিকন্যা বললেন,
"প্রভু আমি তো তোমার কাছে একপতি প্রার্থনা করেছি।" শিব বললেন, "কিন্তু একই প্রার্থনা পাঁচবার করেছ বিধায় তুমি পঞ্চস্বামী প্রাপ্ত হবে।" ব্যাসদেব বললেন, "সেই ঋষিকন্যাই এখন দ্রুপদের কন্যারূপে যজ্ঞ থেকে জাত হয়েছে। তাঁর সাথেই তোমাদের পাঁচ ভ্রাতার বিবাহ হবে। তাই তোমরা পাঞ্চালদেশ যাও।" একথা বলে ব্যাসদেব প্রস্থান করলেন। তারপর পান্ডবগণ দ্রুপদরাজ্যে এসে এক কুমারের গৃহে আশ্রয় নিলেন।
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর ও কুন্তীর নিকট গমন
দ্রুপদরাজ কন্যা দ্রোপদীকে বিবাহ দেয়ার অভিলাষ করলেন। কিন্তু অগ্নি থেকে উদ্ভুত কন্যাকে পাত্রস্থ করার জন্য অগ্নিধারণক্ষম উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন প্রয়োজন। তাই রাজা দ্রুপদ এক বিচিত্র ধনুর্বাণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে দ্রৌপদীর জন্য রাজা ও রাজপুত্রগণ আসতে লাগলেন।
পান্ডবগণও ব্রাহ্মণবেশে স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হলেন। বড় বড় ক্ষত্রিয় মহারথীগণ সেখানে দ্রুপদের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলেন, ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন সেখানে অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করে পাঞ্চালী দ্রৌপদীকে জয় করলেন। তারপর পান্ডবগণ দ্রৌপদীকে নিয়ে কুটিরে ফিরে এলেন। ভীম ও অর্জুন মাতা কুন্তীর উদ্দেশ্যে বললেন, "মা, আজ এক রমণীয় বস্তু ভিক্ষা লাভ করেছি।" কুন্তী দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা পান্ডবগণকে না দেখেই বললেন-
কুটীগতা সা ত্বনবেক্ষ্য পুত্রৌ প্রোবাচ ভুঙক্তেতি সমেত্য সর্ব্বে।
পশ্চাচ্চ কুন্তী প্রসমীক্ষ্য কৃষ্ণাং কষ্টং ময়া ভাষিতমিত্যুবাচ।।
(মহাভারত আদিপর্ব-১৮৪/২)
""কুন্তী ঘরের ভেতর ছিলেন বলে, ভীম ও অর্জুনকে না দেখেই বলে ফেললেন, "তোমরা সকলে মিলে তা ভোগ করো।" পরে তিনি দ্রৌপদীকে দেখে বললেন, "হায়! আমি বড়ই কষ্টের কথা বলে ফেলেছি।"
তারপর কুন্তী ভয়ে ভতি হয়ে দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে বললেন- "পুত্র ভীম ও অর্জুন দ্রুপদ কন্যাকে আমার কাছে ভিক্ষা বলায়, আমিও অনবধানবশত ভিক্ষা মনে করেই বলে ফেলেছি-তোমরা সকলে মিলে ভোগ করো।আমার এই কথা কীভাবে সত্য হতে পারে, এ বিষয়ে যা সঙ্গত হয়, কোনো পাপ যেন দ্রৌপদীকে স্পর্শ না করতে পারে ও দ্রৌপদীও যেন তাতে সম্মত হয় তার উপায় বলো।" কিছুক্ষণ চিন্তা করে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করার কথা বললে অর্জুন মায়ের বাক্যের প্রতি নিষ্ঠা হেতু তাতে অস্বীকৃতি জানালেন।“মানুষের বিবাহে এরূপ বিধান নেই, তবে পান্ডবগণ দেবতাদের অবতার, দ্রৌপদী স্বর্গলক্ষ্মীর অবতার; সুতরাং পূর্বসুকৃতিবশত এবং মহাদেবের অনুগ্রহে এক দ্রৌপদী পঞ্চপান্ডবের পত্নী হবেন।”
আরও পরুনঃ মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী ও উপদেশ
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন ব্যাসদেবের বাক্য স্মরণ করলেন। তারপর তিনি বললেন, "কল্যাণীয়া দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই ভার্যা হবে।" তখন কৃষ্ণ ও বলরাম সেখানে এসে উপস্থিত হন। তারপর কৃষ্ণসহ সকলেই দ্রুপদরাজপ্রাসাদে গমন করেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির দ্রুপদকে সমস্ত বৃত্তান্ত বললেন। তখন দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, "স্বয়ং ধর্মের প্রতিভূ আপনি কীভাবে এমন অধর্ম করতে পারেন? তখন যুধিষ্ঠির বললেন-"মহারাজ, ধর্ম অতি সূক্ষ্ম বিষয়; সুতরাং, আমরা এর গতি বুঝতে পারি না; তাই প্রাচীনেরা যে পথে গিয়েছেন, আমরাও সেই পথের অনুসরণ করে চলি।"
ব্যাসকর্তৃক দ্রুপদকে পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর প্রকৃত পরিচয় বর্ণন
এমন সময় মহর্ষি ব্যাসদেব সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। যথাসম্মান প্রদানের পর দ্রুপদ ব্যাসদেবের নিকট দ্রৌপদীর বিবাহের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন- "একটি স্ত্রী বহু পুরুষের পত্নী হবে, অথচ তাতে কেন পাপ হবে না?" তখন ব্যাসদেব দ্রুপদের হাত ধরে তাকে নিয়ে অন্য একটি কক্ষে প্রবেশ করলেন। তারপর ব্যাসদেব দ্রুপদকে পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত বলতে শুরু করলেন, "মহারাজ, পুরাকালে নৈমিষারণ্যে দেবতারা এক যজ্ঞ করছিলেন।
সেই যজ্ঞের যম পুরোহিত হওয়ার কারণে মানুষদের মারছিলেন না। পৃথিবীতে মানুষ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ আদি দেবগণ যজ্ঞস্থানে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যে একটি স্বর্ণপদ্ম গঙ্গায় ভেসে আসতে দেখে উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র দেখলেন, এক রমণী গঙ্গায় নেমে রোদন করছে ও তাঁর অশ্রুবিন্দু হতে স্বর্ণপদ্ম সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ জিঙ্গেস করলে রমণী ইন্দ্রকে নিকটবর্তী হিমালয়ের উপরে নিয়ে গেলেন; সেখানে এক যুবক এক যুবতীর সাথে পাশা খেলছে।
তারা ইন্দ্রের আগমনেও তাকে সম্মান না জানানোতে ইন্দ্র ক্রোধিত হয়ে বাক্যবাণ প্রয়োগ করলেন। যুবক ইন্দ্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করা মাত্রই ইন্দ্র পাথরের ন্যায় স্থবির হয়ে পড়লেন। পাশাখেলা শেষে যুবকবেশী শিব ক্রন্দনরত রমণীকে বললেন, ইন্দ্রকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। রমণীর স্পর্শে ইন্দ্র চেতনা ফিরে পেল শিব তাকে তার বল দ্বারা একটি পর্বতকে সরাতে বললেন। পর্বত সরিয়ে ইন্দ্র সেখানে চার তেজস্বী পুরুষকে গর্তের ভেতর দেখতে পেলেন।
তখন শিব বললেন, "এরাও তোমারই মতো ইন্দ্র ছিল, অহংকারে মত্ত হওয়ার কারণে আমি তাদের সেখানে আবদ্ধ করে রেখেছি। তুমিও সেখানে প্রবেশ করো।" তখন ইন্দ্র ভয়ে কম্পিত হয়ে শিবের অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। তখন শিব বললেন, "তোমরা মর্ত্যে গিয়ে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করো। "তখন পূর্ববর্তী ইন্দ্রগণ বললেন, "আমরা মর্ত্যলোকে যাব, তবে আমাদের ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র এবং অশ্মিনীকুমারদ্বয়ের মাধ্যমে জননীর গর্ভে স্থাপন করুন।"
তখন মহাদেব শিব তাদের অভিলাষ পূর্ণ করার অঙ্গীকার করলেন। তবে, পঞ্চম ইন্দ্র মহাদেবকে বললেন, দেবগণের কার্য সম্পাদনের জন্য আমি আমার অংশকে পঞ্চম ইন্দ্র করে পাঠাব। পূর্বের ইন্দ্রগণই এবার যুদিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। আর পূর্বে মহাদেব যে স্বর্গলক্ষীকে তাঁদের পত্নী হওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন, তিনিই দ্রৌপদীরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারপর ব্যাসদেব বললেন, এমন দৈবযোগ ব্যতীত যজ্ঞ থেকে কী করে একটি স্ত্রী ভূতল হতে উত্থিত হতে পারে, যার রূপ চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল এবং দেহের সৌরভ একক্রোশ দূর থেকে বাহিত হয়?
তারপর ব্যাসদেব দ্রুপদকে দিব্যদৃষ্টি প্রদান করে পান্ডবগণের পূর্বের ইন্দ্ররূপ দর্শন করালেন। তা দর্শন করে দ্রুপদরাজ অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং পূর্বে দ্রৌপদীর যে জন্মবৃত্তান্ত পান্ডবগণকে বলেছিলেন, তা পুনরায় দ্রুপদকে শোনালেন। সেই স্বর্গলক্ষী পরবর্তীকালে ঋষিকন্যা হয়ে তপস্যা করে পান্ডবগণকে পতিরূপে লাভ করেন। দ্রুপদরাজ তখন ব্যাসদেবকে বললেন, "আপনার মুখ থেকে এই সত্য বাক্য শ্রবণ করে আমার মোহ দূরীভূত হয়েছে। ঈশ্বরবিহীত বিষয়ে নিবৃত্তি করা মানুষের শক্তিসাধ্য নয়। অতএব, দ্রৌপদীকে পঞ্চপান্ডবের হাতে দান করাই যুক্তিসঙ্গত।" ব্যাসদেব বললেন-
নায়ং বিধির্মানুষাণাং বিবাহে দেবা হ্যেতে দ্রৌপদী চাপি লক্ষ্মীঃ।
(মহাভারত-আদিপর্ব-১৯১/৫)
"মানুষের বিবাহে এরূপ বিধান নেই, তবে পান্ডবগণ দেবতার অবতার দ্রৌপদী স্বর্গলক্ষীর অবতার; সুতরাং, পূর্বসুকৃতিবশত এবং মহাদেবের অনুগ্রহে এক দ্রৌপদী পঞ্চপান্ডবের পত্নী হবেন।" দ্রৌপদীর বিবাহ নিয়ে প্রশ্ন,বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব থেকেই শুরু হয়েছে। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। ব্যাসদেব ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ, তিনি জানতেন ভবিষ্যতে মানবসমাজে দ্রৌপদীর বিবাহ নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলবে। তাই তিনি দ্রুপদরাজকে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত নিপুণতার সাথে এই বিভ্রান্তি নিরসন করেছেন। এছাড়াও নারদ পুরাণ, বায়ু পুরাণ ও মার্কন্ডের পুরাণে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর কারণ বর্ণিত রয়েছে।
পঞ্চপান্ডব-ইন্দ্র এবং দ্রৌপদী-ইন্দ্রপত্নী শচী
এবার দেখা যাক, মার্কন্ডেয়পুরাণে এ প্রসঙ্গে কী বলা হয়েছে-"অনন্তর দেবগণ প্রজাসকলের উপকার ও পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন। তখন স্বয়ং ধর্ম তেজোভাগ দ্বারা স্বর্গ হতে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন। তখন স্বয়ং ধর্ম ইন্দ্রদেহজাত সেই তেজ কুন্তীগর্ভে নিক্ষেপ করেন, তারা দ্বারা যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। পবনদেব ইন্দ্রসম্বন্ধীয় যে তেজ কুন্তীগর্ভে নিক্ষেপ করেন,তাতে ভীমসেনের জন্ম হয় এবং কুন্তীগর্ভেই ইন্দ্রের বলার্ধ দ্বরা অর্জুনের জন্ম হয়। আর ইন্দ্রের লাবণ্যধারী অশ্বিনীকুমারদ্বয় দ্বারা মাদ্রীগর্ভে নকুল ও সহদেব নামে যমজকুমারের জন্ম হয়। সুতরাং ইন্দ্রই এই পাঁচ অংশে অবতীর্ণ হন।"
তস্যোৎপন্না মহাভাগা পত্নী কৃষ্ণা হুতাশনাৎ।।
শক্রকস্যৈকস্য সা পত্মী কৃষ্ণা নান্যস্য কস্যচিৎ।
যোগীশ্বরাঃ শলীরাণি কুর্ব্বন্তি বহুলান্যপি।।
পঞ্চানামেকপত্নীত্বমিত্যেতৎ কথিতং ত।
(মার্কন্ডেয় পুরাণ ৫/২৫-২৭)
অর্থাৎ,"দ্রেূপদী একমাত্র ইন্দ্রের পত্মী, অন্য কারো নয়। কারণ, মহাত্মাগণ স্বীয় শরীরকে অনেক ভাগে বিভক্ত করতে সক্ষম হন। হে মহাভাগ, যেভাবে পাঁজনের এক পত্নী হয়েছিল তা আপনার নিকট বললাম।" সাধারণ বিচারবোধ থাকলেও মহাভারতে ব্যাসদেবের সাবলীল বিশ্লেষণ ও মার্কন্ডেয় পুরাণে দ্রৌপদী ও পান্ডবগণের পরিণয় প্রসঙ্গ বোঝা কঠিন হবে বলে মনে হয় না। তবুও স্থুলবুদ্ধির দরুণ কতিপয় ব্যক্তির পক্ষে তা অনুধাবন করাটা কঠিন হতে পারে। তাই তাদের কথা মাথায় রেখে ব্যাসদেবের বর্ণনা থেকে কিছু বিষয় বাস্তবতার নিরিখে আলোকপাত করা হলো-
দ্রৌপদী কোনো সাধারণ নারী নন, পান্ডবগণও সাধারণ পুরুষ নন
দ্রৌপদীর জন্ম হয়েছিল যজ্ঞ থেকে। যুবতী অবস্থায়ই দ্রুপদরাজ দ্রৌপদীকে কন্যারূপে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। মূলত দ্রৌপদী হলেন স্বর্গলক্ষী, যিনি পরবর্তীকালে ঋষিকন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে, শিবকে সন্তুষ্ট করে পাঁচ পতি লাভের বর প্রাপ্ত হন। অপরদিকে পান্ডবগণ সকলেই ছিলেন ইন্দ্র, যারা এ জগতে মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। পূর্বোক্ত মার্কন্ডেয় পুরাণের বর্ণনা অনুসারে এটি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, পান্ডবগণ ইন্দ্র ও দ্রৌপদী ইন্দ্রপত্নী শচী। তাই এখানে দ্রৌপদীর বিবাহ পান্ডবগণ ইন্দ্র ও দ্রৌপদী ইন্দ্রপত্নী শচী। তাই এখানে দ্রৌপদীর বিবাহ পঞ্চপান্ডবরূপী ইন্দ্রের সাথেই হয়েছে। তারা সকলেই অযোনিসম্ভবা। পূর্বসূত্রেই পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী একে অপরের জন্য জন্ম নিয়েছেন। তাই সাধারণ মনুষ্যের বিচার তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া, ব্যাসদেব নিজেই বলেছেন মানুষের বিবাহে এমন বিধান নেই।
তেষামেবায়ং বিহিতঃস্যাদ্বিবাহো যথা হ্যেষ দ্রৌপদীপান্ডবাণাম্।
অন্যেষাং নৃণাং যোষিতাঞ্চ ন ধর্মঃ স্যান্মানবোক্তো নরেন্দ্র।।
(মহাভারত, আদিপর্ব ১৯১/৬)
অর্থাৎ, দেবতাদেরই এরূপ বিবাহ বিহিত আছে। সুতরাং, দেবতাদের বলেই দ্রৌপদী ও পঞ্চপান্ডবের এই বিবাহ হইতেছে; কিন্তু মহারাজ, অন্য মানুষের পক্ষে তা ধর্ম নয়।" তাই তাঁদের বিবাহকে সাধারণ লৌকিক সমাজের দৃষ্টিতে বিচার করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
তৎকালীন নীতিনির্ধারকগণ কর্তৃক স্বীকৃত
বর্তমান সময়ের সাথে মহাভারতের যুগের চিন্তা, ভাবনা, ধ্যান-ধারণা বিচার, সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক পার্থক্য লক্ষণীয়। মহাভারতের যুগে যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল, এখনকার যুগে তা অনেকক্ষেত্রেই পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান সময়ে সমাজব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে যা পূর্বে গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হতো। তাই, দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীকে বিবাহের ঘটনা বর্তমান সময়ের আদলে নয়, বরং তৎকালীন নীতিনির্ধারকগণের সিদ্ধান্তের নিরিখে বিচার করাই যুক্তিসঙ্গত। এখন বিচার করতে হবে, সে যুগে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর ঘটনাটি কীভাবে স্বীকৃত হয়েছিল?
ব্যাসদেব ছিলেন তৎকালীন নীতিনির্ধারকগণের মধ্যে মুখ্য। তিনি দ্রৌপদী ও পান্ডবগণের জন্মবৃত্তান্ত মহারাজ দ্রুপদকে শোনানোর পর দ্রুপদরাজ নিঃসংকোচে ব্যাসদেবের সিদ্ধান্ত প্রসন্নতার সাথে গ্রহণ করলেন। তবে আমাদের আপত্তি কোথায়?।
সম্পূর্ণ মহাভারতে কেবল কর্ণ, দুর্যোধন ও দুঃশাসন ভিন্ন আর কোনো ব্যক্তি দ্রৌপদীকে পঞ্চস্বামীর আরোপ লাগায়নি। বরং, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ ও তৎকালীন সকল মুনি-ঋষি অত্যন্ত আদরের সাথে দ্রৌপদীকে গ্রহণ করেছিলেন। যার প্রমাণ মেলে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। যদি দ্রৌপদীর চরিত্র বিষয়ে কারো মনে কিঞ্চিৎমাত্র কলঙ্কের সংশয় থাকতো, তবে তৎকালীন ভারতবর্ষের সমবেত প্রাজ্ঞ মহর্ষিগণ নিশ্চয়ই রাজসূয় যজ্ঞের মতো মহতী অনুষ্ঠানে দ্রৌপদীকে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যজ্ঞে অংশগ্রহণ করার অনুমতি প্রদার করতেন না, যেখানে ভারতবর্ষের প্রাজ্ঞ মুনি-ঋষি ও রাজাগণ উপস্থিত ছিলেন। দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে সকল বিজ্ঞজনের স্বীকৃতি এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি অগ্নির ন্যায় নিষ্কলুষ, পবিত্র। তিনি নিজে কখনো অপবিত্র হন না, বরং অগ্নির ন্যায় অন্যকে পবিত্র করেন। তাই বর্তমান সময়েও কতিপয় কর্ণ, দুর্যোধন ও দুঃশাসন আছে, যারা এখনো দ্রৌপদীর চরিত্রে কালিমা লেপন করতে চায়।
দৈবনির্ধারিত
আমরা
পূর্বের বর্ণনায় দেখেছি যে, ত্রিকালদর্শী ব্যাস পূর্বেই পঞ্চপান্ডবদের
দ্রৌপদীর সঙ্গে তাদের বিবাহ হবে বলে জানিয়েছেন এবং তিনিই তাদের পাঞ্চাল
রাজ্যে যাবার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাই, সম্পূর্ণ ঘটনাটিই যে দৈবের
দ্বারা পূর্বনির্ধারিত তা পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর জন্ম থেকেই স্পষ্ট বোঝা
যায়। দৈবনির্ধারিত ঘটনাটি ঘটানোর উপলক্ষ হিসেবেই এখানে কুন্তীর আদেশের
প্রয়োগও দৈবক্রমে হয়েছে। এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়।
কুন্তীর আদেশ ও যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্ত
উপরের বর্ণনানুসারে মাতা কুন্তী তিনটি বিষয়কে ঠিক রেখে যুধিষ্ঠিরের কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিলেন-
- আমার কথার সত্যতা যেন রক্ষা হয়
- দ্রেূৗপদীর যেন পাপ না হয়
- দ্রৌপদী যেন তাতে সম্মত থাকে
পাঁচ
ভাইয়েরই দ্রৌপদীর পানিগ্রহণ করা অথবা দ্রৌপদীকে বিবাহ না করা- এক্ষেত্রে
দ্রৌপদীর অপমান হবে, যা পূর্বে অম্বার ক্ষেত্রে ভীষ্ম কর্তৃক হয়েছিল। তাই
প্রথম বিকল্পটি গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তখন যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবের
কথা স্মরণ করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটিই দ্রৌপদী ও তাঁদের নিয়তি। তখন
তিনি প্রথম বিকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। আরেকটি বিষয় এখানে মনে
রাখতে হবে যে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বয়ং বিবাহের পূর্বেই এটি ধর্মের
মানদন্ডে বিচার করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
তাই এটি আকস্মিক বা ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নয়। এখন, প্রশ্ন হতে পারে, কন্তীর আরেকটি শর্ত ছিল দ্রৌপদী যেন এতে সম্মত হয়। কিন্তু দ্রৌপদী কি যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে সম্মত হয়েছিলেন? হ্যাঁ, কারণ তিনি এটাকে ত্রিকালদর্শী মহর্ষি ব্যাসদেবের বাক্য বলে গ্রহণ করেছিলেন এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বয়ং তাতে সম্মত হয়েছিলেন। আদিপর্বের ১৮৫/৭ শ্লোকে দ্রৌপদী যে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন তা প্রমাণিত হয়, "সচ্চরিত্রা দ্রৌপদী মাতা কুন্তীর আদেশকে ভালো বলেই মনে করলেন, তাই তিনি রাজকন্যা হয়েও আনন্দের সাথে তাঁর আদেশানুসারে কার্য করলেন।" কিন্তু বর্তমানসময়ে বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলে প্রচারিত মহাভারতের কোনো কোনো সিরিয়ালে এ প্রসঙ্গে দ্রৌপদীকে অভিযোগ করতে দেখা যায়, যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। উপর্যুক্ত শ্লোকটি মহাভারত থেকে দেখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। সর্বোপরি সাধ্বী ও পতিব্রতা দ্রৌপদী এ ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ গুরুহনদের সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণরূপে সম্মত ছিলেন।কুন্তী কেন তাঁর বাক্য ফিরিয়ে নিলেন না।
মাতা কুন্তী তাঁর বাক্য ফিরিয়ে নিতে পারেননি, কারণ সেসময় কথার অনেক মূল্য ছিল। ধার্মিকগণ তাঁদের সত্যতা, বচন রক্ষা করতেন। দশরথ কৈকেয়ীকে কথা দিয়েছিলেন যে, তাকে দুটি বর দিবেন যখন কৈকেয়ী বরস্বরূপ তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় শ্রীরামকে চাইলেন, তখন দশরথ তাঁর কথা ফিরিয়ে নিতে পারতেন, কিন্তু তাঁর প্রাণ বহির্গত হওয়ার উপক্রম হলেও তিনি তা করেননি। আবার, প্রভু শ্রীরামাও পিতৃসত্য পালন করেছিলেন। এমনকি মাতা কৈকেয়ী যখন তার ভুল বুঝতে পেরে শ্রীরামকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, তখনও শ্রীরাম প্রত্যাবর্তনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। আবার, পিতামহ ভীষ্ম হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে আসীন রাজার প্রতি তাঁর আনুগত্য রাখার বচন হেতু দুর্যোধনের অন্যায় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছিলেন, অর্থাৎ সে সময় বাক্যের অনেক মর্যাদা ছিল। তাই কুন্তীদেবী দ্রৌপদীর প্রতি কোনো অবিচার না করেই তার বাক্য রক্ষা করে সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন।
পান্ডবগণ কেন তাদের মায়ের আদেশ মেনে নিলেন
মাতা গুরুসম। তাই, মায়ের আদেশ সন্তানের উলঙ্ঘন করা উচিত নয়। কুন্তী অনবধানে বললেও তা পঞ্চপান্ডবদের প্রতি ছিল আদেশস্বরূপ। পান্ডবগণ সর্বদা তাদের মায়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন, তাই পান্ডবগণকে মাতা কুন্তীর এ আদেশও পালন করতে হয়েছিল।
পঞ্চপান্ডবের পত্নীরূপে দ্রৌপদীর আচরণ কেমন ছিল?
অনেকরই প্রশ্ন, দ্রৌপদী পঞ্চপান্ডবের সাথে কীরূপ আচরণ করতেন? এই প্রশ্ন শুধু আমাদেরই নয়। মহাভারতে পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয় নিজেই এ প্রশ্ন করেছেন- "একা দ্রৌপদী পঞ্চপান্ডবের ধর্মপত্নী হয়ে কীভাবে ধর্ম রক্ষা করে চলতেন? উত্তরে বৈশম্পায়ন সবিস্তারে পান্ডবগণের সাথে দ্রৌপদীর আচরণ বর্ণনা করেন। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর পান্ডবগণ ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন। তখন নারদ মুনি সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।
অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের পর নারদ মুনি পান্ডবগণকে বললেন- "দ্রৌপদী তোমাদের ধর্মপত্নী, তাই দ্রৌপদীকে নিয়ে তোমাদের মধ্যে যেন বিবাদ উপস্থিত না হয়, তেমন নিয়ম করো। কারণ, পুরাকালে সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই ভাইয়ের মধ্যে অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তিলোত্তমা নামে এক স্ত্রীর জন্য পরস্পরকে বধ করে।" তারপর নারদ মুনি তাদের সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনী সবিস্তারে বললেন। নারদ মুনির কথা শ্রবণ করে ধর্মাত্মা পান্ডবগণ দেবর্ষি নারদের সমক্ষে একটি নিয়ম করলেন যে, "দ্রৌপদী একেক জনের ঘরে একেক বৎসর অবস্থান করবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ দ্রৌপদীর সঙ্গে বসবাসকালে, অন্য যে কেউ সেখানে প্রবেশ করলে, বারো বছর বনে বাস করবেন।" দ্রৌপদী এক বছর এক পতির গৃহে বাস করার পর যখন অন্য পতির গৃহে যেতেন, তখন অগ্নিসম্ভূতা দ্রৌপদী অগ্নিস্নান করতেন। এভাবে ধর্মাত্মা পান্ডবগণ সাধ্বী দ্রৌপদীর সাথে ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করতে লাগলেন।
দ্রৌপদী চরিত্রের মহিমা ও পবিত্রতা
দ্রৌপদীর দিব্যতা, সতীত্ব কেবল তাঁর জন্মের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত নয়, এ জগতে প্রকটকালীনও তাঁর দিব্যতা, পবিত্রতা, সতীত্ব ও আদর্শ বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। হস্তিনাপুরের রাজসভায় দুর্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনির চক্রান্তের দ্বারাও দ্রৌপদীর সতীত্ব ও পবিত্রতায় কোনো আঁচ পড়েনি। বরং, বস্ত্রহরণের প্রয়াসের দ্বারা দ্রৌপদীর সতীত্বের
অগ্নির তাপ সমবেত সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন। এই ঘটনায় দ্রৌপদীর সতীত্ব ও পবিত্রতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা ইতিহাসে অদ্বিতীয়। দ্রৌপদী সর্বতোভাবে কৃষ্ণের চরণে সমর্পিত ছিল। কৃষ্ণ কেবল ন্যায়পরায়ণ ধার্মিকদেরই রক্ষা করতেন। হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রৌপদীর আহ্বানে কৃষ্ণই দ্রৌপদীসহ পান্ডবদের রক্ষা করেছিলেন।
তাছাড়া সম্পূর্ণ মহাভারতে বিভিন্ন সময় কৃষ্ণ দ্রৌপদীর কথোপকথনে দ্রৌপদীর কৃষ্ণের প্রতি সমর্পণ ও ভক্তির গাঢ়তা প্রকাশ পায়। যা মহাভারতের যুদ্ধ শেষে দ্রৌপদীর পাঁচসন্তানকে বধ করার অমার্জনীয় অপরাধে যখন অর্জুন অশ্বত্থামাকে মৃত্যুদন্ড দিতে উদ্দত, তখন দ্রৌপদী অশ্বত্থামাকে মৃত্যুদন্ড দিতে নিষেধ করেন, কারণ তিনি তাঁর নিজ সন্তান হারানোর ব্যথার দ্বারা অশ্বত্থামার মায়ের অবস্থা অনুভব করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন,
"আমি যেমন আমার পুত্রবিয়োগে কষ্ট পাচ্ছি, অশ্বত্থমার মৃত্যুতে অশ্বত্থামার মায়ের অবস্থা অনুভব করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, "আমি যেমন আমার পুত্রবিয়োগে কষ্ট পাচ্ছি, অশ্বত্থামার মৃত্যুতে অশ্বত্থামার মাতাও তেমন কষ্ট পাবে।" এমন মহানুভবতার পরিচয় ইতিহাসে বিরল। এ ঘটনার মাধ্যমে দ্রৌপদী চরিত্রের কোমলতা প্রস্ফুটিত হয়।
আরও পড়ুনঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত
সর্বোপরি মহাভারতের অসাধারণ নারী চরিত্র দ্রৌপদীর জন্ম ও কর্ম বৃত্তান্ত জানলে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে, অগ্নি যেমন কোনো কিছুর দ্বারাই অপবিত্র হয় না। তেমনি অগ্নি থেকে উত্থিত যজ্ঞসেনী দ্রৌপদী অগ্নির ন্যায় পবিত্র। তিনি এ জগতের সাধারণ কোনো নারী নন যা পূর্বের আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে। তাই পঞ্চপান্ডবকে দ্রৌপদীর পতিরূপে বরণ করা কখনোই অধর্ম নয়। কারণ, এই পঞ্চান্ডব সকলেই ছিলেন ইন্দ্রেরই প্রকাশ; আর দ্রৌপদী ছিলেন ইন্দ্রপত্নী শচী। পূর্বের পতি-পত্নীর সম্পর্কই ঘটনাক্রমে দ্রৌপদী ও পঞ্চপান্ডবের পরিণয়ে পুনঃস্থাপিত হয়েছে।- হরেকৃষ্ণ।
আরও পড়ুন
সনাতন ধর্ম সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
আরো জানুনঃ
কেন প্রসাদভোজী হবেন? সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র (বেদ,সংহিতা, মহাভারত, গীতা,ভাগবত,পুরাণ,উপনিষদ) থেকে প্রমান দেওয়া হলো...
চার যুগ-সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর ও কলির সময় পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কিছু অমৃত বাণী
মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কিছু বাণী ও উপদেশ
মনুষ্য দেহের কথা আলোচনা
আপনি কি অনেক হতাশায় ভুগছেন? সকল সমস্যাগুলোর সমাধান খুজে পান!!!!!!!!!!
ভগবান বিষ্ণুর গাত্র বর্ণ নীল কেন?
এই জগতে প্রকৃত জ্ঞানী,কে এই জগতে প্রকৃত সুখী,আর কে-ই বা প্রকৃত দুঃখী ?
অনাচার কাকে বলে ও কয় প্রকার?
কলিযুগের মানুষদের ভগবানের নামে রুচি নেই কেন ?
ঘট কিসের প্রতীক?
সনাতন ধর্মের বৈদিক শাস্ত্রে জন্ম ও মৃত্যুযোগ অশৌচ কি?
মহাভারত পড়ার সময় না থাকলেও এর মূল সূত্রগুলি আমাদের জীবনে কার্যকর প্রমাণ করতে পারে-----------------------
মহাভারতের কিছু বাণী
শ্রীমদভগবদগীতায় উচ্চারিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল নামের অর্থ ও মাহাত্ম্য
প্রকৃত ভালোবাসার খোঁজে..........
রাধাকৃষ্ণের প্রেম-কাহিনীর প্রকৃত রহস্য
ভক্তি কি ?
মায়া কি? মায়া থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন মাথায় ময়ূরপালক/পুচ্ছ পরিধান করতেন?
রাজা পুরঞ্জনের কেন পরবর্তী জন্মে নারী হয়ে জন্ম হয়েছিল ?
আরো পড়ুন.....
0 মন্তব্যসমূহ