জগন্নাথের আবির্ভাব লীলা , রথযাত্রার সূচনা ও মহিমাঃ Advent of Jagannath Leela, beginning of Rathyatra and glory

শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের প্রণাম মন্ত্রঃ

নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।

বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ। ।


অনুবাদঃ

পরমাত্মা স্বরুপ যাঁরা নিত্যকাল নীলাচলে বসবাস করেন, সেই বলদেব, সুভদ্রাও জগন্নাথদেবকে প্রণতি নিবেদন করি
 

জগন্নাথের আবির্ভাব 

 পদ্মপুরাণ অনুসারে, মালবরাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন বিষ্ণুর প্রবল ভক্ত তিনি শ্রীক্ষেত্র (বর্তমানে জগন্নাথ ধাম নামে পরিচিত) নামে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু মন্দিরে কোনো মূর্তি ছিল না। একদিন রাজ্যসভায় কেউ নীলমাধবের কথা বলল। নীলমাধব বা বিষ্ণুর একটি রূপ। তাকে কোথায় পাওয়া যাবে? কেউ জানে না. তাই রাজা লোক পাঠালেন নীলমাধবকে খুঁজতে কিন্তু নীলমাধব কি এত সহজে দেখা যায়? কেউ তাকে খুঁজে পেল না সবাই যখন হতাশ, শুধু বিদ্যাপতিকে দেখা গেল না। সে বনে পথ হারিয়ে ফেলে। তারপর গল্পে ভালোবাসার ছোঁয়া ছিল। শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা বনে হারিয়ে যাওয়া বিদ্যাপতিকে উদ্ধার করেন। সেই সূত্রে তাদের মধ্যে অনুভূতি বাড়ে, ধীরে ধীরে তা প্রেমে রূপ নেয়। কিছুদিন প্রেমের পর নবদম্পতি ললিতা ও বিদ্যাপতি বিয়ে করে বনে সংসার শুরু করেন। এদিকে বিদ্যাপতি লক্ষ্য করলেন, তার শ্বশুরবাড়িতে প্রতিদিন স্নান সেরে কোথাও না কোথাও যেতেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, বনের গভীর পাহাড়ে নীলমাধবের মূর্তি আছে। বিশ্ববসু প্রতিদিন নীলমাধবের পূজা করতে সেখানে যেতেন। নীলমাধবের কথা জেনে খুশি হলেন বিদ্যাপতি। তার পরাজয় সফল বলে মনে হচ্ছে! জানার সাথে সাথে তিনি বিশ্ববসুকে নীলমাধব দেখতে অনুরোধ করলেন। প্রথমে অখুশি থাকলেও শেষ অবধি জেদি জামাইয়ের অনুরোধ মেনে নিতে হয় তাকে। বিদ্যাপতি তৎক্ষণাৎ ভক্তিভরে নীলমাধবাকে পূজা করলেন। এবং তারপর ভবিষ্যদ্বাণী স্বর্গ থেকে নেমে এল, "এখন পর্যন্ত গরিবদের পূজা করেছি, এবার মহা-উপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজা করতে চাই।" নীলমাধব নিজে যখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন্যের পূজা করতে চান, তখন কি আর বিলম্ব করা যায়? তৎক্ষণাৎ রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে খবর পাঠানো হয়। রাজা আশ্চর্য হয়ে সমস্ত ব্যবস্থা করলেন এবং নীলমাধবকে বনের মাঝখানে নিয়ে যেতে হাজির হলেন। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছতেই নীলমাধবের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। তারপর আবার ভবিষ্যদ্বাণী শোনা গেল, "সমুদ্রের জলে যে কাঠ ভেসে উঠবে সেই কাঠের মূর্তি হবে" (অর্থাৎ নীলমাধবের মূর্তি)। সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন সাগরের জলে কাঠ ভেসে উঠল। শোভাযাত্রায় শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। কিন্তু কিভাবে বানাবেন? ভাসমান কাঠ এতই শক্ত যে কেউ কাঠের উপর হাতুড়ি লাগাতে পারে না; উল্টো হাতুড়ির দিকে যায় অবস্থা! তাহলে মূর্তি গড়বে কে? মহারাজ আবার বিপদে পড়লেন ইন্দ্রদ্যুম্নের অসহায় অবস্থা দেখে বুঝলাম এবার ঈশ্বরের দুঃখ। স্বয়ং জগন্নাথ শিল্পী রূপ ধারণ করে রাজপ্রাসাদের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ভগবানের মূর্তি গড়বেন তিনি। কিন্তু তার একটা শর্ত আছে শর্ত হল তিন সপ্তাহ বা ২১ দিনের আগে কেউ তার খোদাই দেখতে পারবে না। এরপর শর্ত অনুযায়ী কাজ শুরু করেন কাঠমিস্ত্রি। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণী গুন্ডিচরের দেরি সহ্য হয়নি। একদিন ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখলেন কারিগর নিখোঁজ! তিনটা অর্ধ-সমাপ্ত মূর্তি দেখে ঠিকমতো ভার্মি খেলেন! গোলাকার চোখ, গোল মুখের অসমাপ্ত মূর্তির হাত নেই, পা নেই। এই অবস্থা দেখে রাজা ও রাণী উভয়েই অনুতপ্ত ও দুঃখে আপ্লুত হলেন। তিনি ভাবলেন, শর্ত ভঙ্গের ফলে এত বড় শাস্তি পেয়েছে তারা। যাইহোক, ঈশ্বর তাদের এই অনুশোচনার সময়কে দীর্ঘায়িত করার অনুমতি দেননি। স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে জগন্নাথ বললেন, "আগে থেকেই ঠিক করা হয়েছিল যে আমি এভাবেই পূজা পেতে চাই।"

 

জগন্নাথদেব জগন্নাথের মূর্তির রূপ নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন রয়েছে। হাত-পা ছাড়া তার শরীর কেন, তার অবতার কেন এত অদ্ভুত? এ প্রসঙ্গে স্বয়ং দেবতার কিছু বিশ্লেষণ দেখা যায়। কথোপনিষদ বলে, "ন আত্মাং রথিনাংবিদ্যা শরিরং রথমেবতু"। অর্থাৎ এই দেহই রথ আর ​​আত্মা হল দেহ-সদৃশ রথের রথ। ঈশ্বর অন্তরে বাস করেন। এর কোনো রূপ নেই। তিনি সর্বব্যাপী। বেদ বলে, ‘অবংমানসগচর’। অর্থাৎ মানুষের কথা ও মনের ঊর্ধ্বে। মানুষ তাই তাকে মানবিকভাবে সাজায়। এটি কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় শ্বেতাস্বতার উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে- "আপনিপদ জবানো রিসিভার পশ্যত্যচকসুঃ সা শ্রীনোত্যকর্ণঃ। সা বেত্তি বেদ্যাং ন চ তস্যস্তি বেত্তা তমহুরগ্রায়ং পুরুষং মহন্তম্''।। অর্থাৎ তার পার্থিব হাত নেই, কিন্তু সে সব কিছু মেনে নেয়। তার কোন পদ নেই, কিন্তু সে সব জায়গায় যায়। তার চোখ নেই, কিন্তু সে সব দেখে। কান নেই, কিন্তু সবাই শোনে। তাকে চেনা কঠিন, তিনি পৃথিবীর পূর্বপুরুষ। এই বামন হল মহাজাগতিক আত্মা, এর কোন রূপ নেই, আকৃতি নেই। উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীকী রূপ পুরীর জগন্নাথদেব। তার সম্পূর্ণ মূর্তি তৈরি করা সম্ভব ছিল না, কারণ মানুষ তার রূপ তৈরি করতে অক্ষম। শুধুমাত্র প্রতীক দেখানো হয়.

 

 

জগন্নাথ মন্দির হিন্দুদের চারটি ধামের মধ্যে একটি হল জগন্নাথের মন্দির। সকল সনাতনীদের জন্য এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান। জগন্নাথ মন্দিরটি পুরীর পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। মন্দিরটি প্রাথমিকভাবে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্বপ্ন পূরণের জন্য নির্মিত হওয়ার পর, দ্বাদশ শতাব্দীতে গঙ্গা রাজবংশের রাজা অনন্তবর্মন চোদাগঙ্গা দ্বারা জগন্নাথ মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বংশধর অঙ্গভিমা দেব মন্দিরের কাজ সম্পন্ন করেন। তবে মন্দিরের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরটি 10.6 একর জমির উপর 20 ফুট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মন্দিরে ভোগমন্দির, নাটমন্দির, জগমোহন এবং দেউল নামে চারটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে। ভোগমন্দিরে খাবার পরিবেশন করা হয়, নাটমন্দিরে নৃত্য ও গানের আয়োজন করা হয়, ভক্তরা জগমোহনায় পূজা করেন এবং দেউলে প্রতিমা স্থাপন করা হয়। মূল মন্দিরের কাঠামো মাটি থেকে সামান্য উপরে নির্মিত এবং দুটি আয়তাকার দেয়াল দ্বারা আবৃত। বাইরের প্রাঙ্গণটিকে বলা হয় মেঘনাদ প্রাচীর (200 m/192 m) এবং ভেতরের ভিত্তিটি কুর্মবেদ (128 m/95 m) নামে পরিচিত। মন্দিরটির চারটি প্রবেশদ্বার রয়েছে - সিংহদ্বার, হশদ্বারা, খঞ্জদ্বারা এবং হস্তিদ্বারা। জগন্নাথ মন্দিরের আশেপাশে প্রায় ত্রিশটি ছোট-বড় মন্দির দেখা যায়। মন্দিরের দেওয়ালে জগন্নাথ, জগন্নাথের পিতামহ বলরাম এবং বোন সুভদ্রা দেবীর মূর্তি শোভা পাচ্ছে। তাদের মূর্তি ছাড়াও, সুদর্শন, শ্রীদেবী, ভুদেবী এবং মাধব দেবতাদেরও ভক্তরা পূজা করেন। এখানে প্রতিদিন সকালে কিশোর ছেলেরা কিছু আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করে এবং মন্দিরের 75 মিটার (210 ফুট) উপরে উঠে এবং চাকায় পতাকা রাখে। গ্রীষ্মে, বর্ষায় তারা সর্বদা প্রস্তুত পতাকা রাখে। আগের দিনের পুরনো পতাকাগুলো নিলামে বিক্রি হয় মানুষের মাঝে। জগন্নাথ মন্দিরের রান্নাঘরটিকে বিশ্বের বৃহত্তম রান্নাঘর হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। প্রায় পঞ্চাশটি বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে এখানে তৈরি হয় মহাপ্রসাদ। এখানে প্রতিদিন প্রচুর রান্না করা হয়, তবে মন্দিরের খাবার কখনই নষ্ট হয়নি। জগন্নাথ মন্দিরের অস্বাভাবিকতা ও লোককাহিনী জগন্নাথ মন্দিরের উপরের অংশে রত্নমুর নামে একটি বড় অদ্ভুত চৌম্বকীয় শক্তি রয়েছে, যা মন্দিরটিকে যে কোনো ধরনের ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করা হয়। কথিত আছে যে মন্দিরের ভিতর দিয়ে কিছু যাওয়া যাবে না। মন্দিরের ওপর দিয়ে কোনো পাখিকে উড়তে দেখা যায়নি। কথিত আছে সূর্যের অবস্থান যাই হোক না কেন, মাটিতে মন্দিরের চূড়ায় কোনো ছায়া থাকে না। জগন্নাথ মন্দির জগন্নাথ মন্দির পুরীর সমুদ্রের কাছে অবস্থিত। কিন্তু মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলেই সাগরের কোনো শব্দ নেই। এর কারণ ব্রহ্মা বলেছেন যে সুভদ্রা দেবী মন্দিরের অভ্যন্তরে শান্তি বিরাজ করতে চেয়েছিলেন, তাই কোনও শব্দ মন্দিরের শান্তিকে বিঘ্নিত করতে পারে না। প্রতিদিন সকালে মন্দিরের শীর্ষে পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকাকে সবসময় বাতাসের বিপরীতে উড়তে দেখা যায়। জগন্নাথ দেবের মন্দিরের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এরকম অনেক লোককাহিনী।

 জগন্নাথের আবির্ভাব , রথযাত্রার সূচনা ও মহিমাঃ

রথযাত্রার সূচনা

 উড়িষ্যার প্রাচীন গ্রন্থ ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে জগন্নাথের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সত্যযুগে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল। তখন উড়িষ্যা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল। মালাবাদের সূর্য রাজবংশের পরম বিষ্ণু ভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্ন, জগন্নাথের রূপে ভগবান বিষ্ণুর একটি মূর্তি নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং রথযাত্রার স্বপ্নের আদেশও পেয়েছিলেন। পরে তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও পুরীতে রথযাত্রার প্রচলন। আবার বাংলায় রথের প্রচলনের প্রসঙ্গ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলায় রথযাত্রার সূচনা পুরীর জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা থেকে। চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই অংশটিকে বাংলায় নিয়ে আসেন চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা পুরীর অনুকরণে বাংলায় রথযাত্রা প্রবর্তন করেন। এখন এই রথযাত্রা বাংলার অনেক জায়গায় খুবই জনপ্রিয় রথ উৎসব বাংলা মাসের আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিনে পালিত হয়। এই দিনে জগন্নাথ তাঁর পিতামহ বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে গুন্ডিচা মন্দিরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সাত দিন পর তিনি তাঁর মন্দিরে ফিরে আসেন। প্রস্থানের দিনকে বলা হয় সোজা রথ এবং একই ভাবে মন্দিরে প্রত্যাবর্তনকে বলা হয় বিপরীত রথ। তারা পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথ ঠেলে যাত্রা শুরু করল। অনেকে মনে করেন গুন্ডিচা মন্দিরে যাওয়া মানে আবার মাসির বাড়ি যাওয়া। প্রাচীন সূত্রে জানা যায়, গুন্ডিচা ছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী। তবে এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। পুরীতে রথ উৎসব স্কন্ধপুরাণ সরাসরি জগন্নাথের রথযাত্রার কথা উল্লেখ করেছে। সেখানে মহর্ষি জৈমিনী ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন এবং রথের আকার, সাজসজ্জা, পরিমাপ ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন। ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র’ বা ‘শ্রীক্ষেত্র’ আসলে পুরী মানে। যেহেতু জগন্নাথ দেবের মন্দির পুরীতে অবস্থিত, তাই এই মন্দিরটিকে পবিত্রতম স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এর অন্যতম আকর্ষণ হল রথযাত্রা। প্রতি বছর স্থানীয় রাজা শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। রাজত্ব না থাকলেও পুরীর রাজপরিবার আজও আছে। রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে, যিনি রাজা উপাধি পান তিনি হলেন পুরীর রাজা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর পর তিনটি রথের সামনে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন এবং রথের সামনের অংশ ঝাড়ু দেন। সোনার ঝাড়ু এবং সুগন্ধি জল। তারপর পুরীর রথের দড়ি টানা হয়। জগন্নাথের শোভাযাত্রা শুরু হয়। তিনজনের জন্য তিনটি আলাদা রথ। এই তিনটি রথও রথযাত্রা উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তিনটি রথযাত্রার জন্য কিছু নিয়ম রয়েছে এবং রথের আকার এবং রঙও আলাদা। যেমন- প্রথমে বড় ভাই বলভদ্রের রথ যাত্রা শুরু করে। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথের চৌদ্দটি চাকা রয়েছে। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রং নীল। এরপর ভগিনী সুভদ্রার রথ যাত্রা করে। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের বারোটি চাকা রয়েছে। রথের পতাকায় পদ্মের চিহ্ন থাকায় রথকে পদ্ম পতাকাও বলা হয়। রথের আবরণের রং লাল। সবশেষে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ বা জগন্নাথের রথ। রথের নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি রয়েছে, তাই এর নাম কপিধ্বজ। রথের উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এর ষোলটি চাকা রয়েছে। রথের আবরণের রং হলুদ। তিনটি রথের আবরণের রঙ ভিন্ন হলেও প্রতিটি রথের পৃষ্ঠতল লাল। রথটি তিন সমুদ্রতীরবর্তী জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে গুন্ডিচা মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করে। লাল আবরণে তিনটি রথ চলছে পুরীর রথ উৎসবে; সেখানে সাতদিন থাকার পর উল্টো রথে মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ। বর্তমানে তিনটি রথ ব্যবহার করা হয়। যদিও প্রায় সাতশত বছর আগে রথযাত্রার পথ দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। আর ওই দুই অংশে তিন তিন করে মোট ছয়টি রথ ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ, সে সময় জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা পর্যন্ত রাস্তার মাঝখানে প্রশস্ত বালাগুন্ডি খাল বয়ে যেত। তাই যখন তিনটি রথ জগন্নাথ মন্দির থেকে বালাগুন্ডি খালের ওপারে আসত, তখন জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তিগুলি রথ থেকে নেমে খাল পার হয়ে অন্য তিনটি রথে বসে অন্য পাড়ে অপেক্ষা করত। . 1272 খ্রিস্টাব্দে, রাজা কেশরী নরসিংহ পুরী রাজ্য দখল করার পর, তার রাজত্বের কোনো এক সময়ে বালাগুন্ডি খালটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে পুরীতে তিনটি রথ ছিল। রথ চলাকালীন, রথযাত্রায় অংশ নিতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় পনের থেকে বিশ লাখ হিন্দু পুরীতে আসেন। ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, “রথস্থ বম ন, অর্থাৎ বামন জগন্নাথকে রথে বসে থাকতে দেখলে তার পুনর্জন্ম হয় না, তাই ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা চ-এর দড়ি টানাকে মনে করেন।  

 

 

রথযাত্রা উৎসবের তাৎপর্য্যঃ

রথারূঢ়ো গছন পথি মিলিত ভূদেবপটলৈঃ... |

জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে ॥

জগৎ শব্দের অর্থ বিশ্ব এবং নাথ শব্দের অর্থ ঈশ্বর। সুতরাং যিনি জগতের ঈশ্বর,যাঁর থেকে সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, যিনি সবাইকে পালন করছেন এবং অবশেষে প্রলয়ের সময় যাঁর মধ্যে সবকিছু লীন হয়ে যায় তিনিই হচ্ছেন জগন্নাথ দেব ।

যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ । “শ্রী জগন্নাথ তাঁর ভ্রাতা বলরাম এবং ভগ্নী সুভদ্রা মহারাণীকে নিয়ে রথ উপবিষ্ট হন এবং ভক্তরা স্তুতি, কীর্তন করতে করতে শােভাযাত্রা সহকারে রথ টেনে বৃন্দাবনের দিকে যাত্রা করেন তাঁকে বলা হয় রথযাত্রা।”

এই রথযাত্রার প্রথম শুরু হয় কুরুক্ষেত্রে ৫০০০ বছর আগে বৃন্দাবনবাসী কর্তৃক। বৃন্দাবন হতে নন্দসূত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকালীলায় প্রবেশ করলেন। এরপর সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে তিনি যখন কুরুক্ষেত্রে পবিত্র ব্রহ্ম সরােবরে স্নান করতে গিয়েছিলেন, তার জেষ্ঠ্য ভ্রাতা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রা সহ দ্বারকাবাসীরাও তাঁর সাথে গিয়েছিলেন। সেইসময় শ্রীমতি রাধারাণী, অষ্টসখী, অন্যান্য গােপীগণ সহ সমস্ত ব্রজবাসীরাও নন্দ মহারাজের সহিত সর্যগ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হন। প্রায় ১০০ বছর পরে বৃন্দাবনবাসীদের সাথে ভগবান শ্রীকষ্ণের পুনরায় সাক্ষাৎ হল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে রাজবেশে দেখে ব্রজবাসীদের আনন্দ হল না। তারা শ্রীকৃষ্ণকে ব্রজে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বজের বেশে দেখতে চাইলেন এবং তাঁর সাহচর্য পেতে চাইলেন। তাই তারা কৃষ্ণ, বলরাম, সুভদ্রা দেবীর রথের ঘােড়া ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রথ টানতে বনতে বন্দাবনে নিয়ে গেলেন। সেই লীলাকে স্মরণ করে ভক্তরা এখনও পুরীর জগন্নাথ মন্দির (অভিন্ন দ্বারকা রাজ্য, শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য লীলার স্থান) থেকে জগনাথ বলদেব এবং সুভদ্রা মহারাণীর রথ টানতে টানতে গুণ্ডিচা মন্দিরে (শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য লীলার স্থল বৃন্দাবন) নিয়ে যান। এই অনুষ্ঠান হয় আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়া তিথিতে (জুন -জুলাই মাসে)।

ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি, পরম শুদ্ধ ভক্ত। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন মহাপ্রভুর বাণী “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম, সর্বত্র প্রচার হবে মাের নাম” সার্থক করার জন্য। তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের নির্দেশে পাশ্চাত্যে গমন করেন এবং ১৯৬৭ সালের ৯ জুলাই সানফ্রান্সিসকোতে ভারতবর্ষের বাইরে প্রথম রথযাত্রার সূচনা করেন। তাঁরই কৃপায় লন্ডন, ইতালী, প্যারিস, নিউইয়র্ক, সুইডেন, জাপান, চীন, আফ্রিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, রাশিয়াসহ ১২০ টিরও অধিক দেশে রথযাত্রা উদ্যাপিত হচ্ছে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই জগন্নাথের রথযাত্রায় মেতে উঠেছে। সুতরাং, জগন্নাথ এখন শুধু পুরীতেই নয় সমগ্র বিশ্বে দিব্যরথে ভ্রমণ করছেন। রথযাত্রা ভগবানের সবচেয়ে মাধুর্যময় লীলা। কারণ, এতে সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসা যায়। জগন্নাথ এতই কৃপাময় যে যারা মন্দিরে এসে ভগবারকে দর্শন করে না তাদেরকে পর্যন্ত কৃপা করার জন্য তিনি ভক্তপরিবেষ্টিত হয়ে ভ্রাতা বলরাম ও সুভদ্রা দেবীসহ রথে পরিভ্রমণ করেন। রথােপরি জগন্নাথদেবকে একবার দর্শন করলেই দর্শনকারীর মুক্তি লাভ হয়ে-“রথে বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।” কেউ যদি রথের দড়ি টানে, রথ স্পর্শ করে বা রথােপবিষ্ট জগন্নাথদেবকে দর্শন করে, তাহলে তাকে পুনরায় জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ হতে হয় না। এই উৎসবে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্য হল আত্মােলব্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া। সুতরাং, আমাদের প্রত্যেককে রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করে শ্রী জগন্নাথদেবের কৃপা লাভ করা উচিত। সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

- হরে কৃষ্ণ

সনাতন ধর্ম সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-

আরো জানুনঃ

কেন প্রসাদভোজী হবেন? সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র (বেদ,সংহিতা, মহাভারত, গীতা,ভাগবত,পুরাণ,উপনিষদ) থেকে প্রমান দেওয়া হলো...

চার যুগ-সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর ও কলির সময় পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহঃ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কিছু অমৃত বাণী

মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কিছু বাণী ও উপদেশ

মনুষ্য দেহের কথা আলোচনা

আপনি কি অনেক হতাশায় ভুগছেন? সকল সমস্যাগুলোর সমাধান খুজে পান!!!!!!!!!!

ভগবান বিষ্ণুর গাত্র বর্ণ নীল কেন?

এই জগতে প্রকৃত জ্ঞানী,কে এই জগতে প্রকৃত সুখী,আর কে-ই বা প্রকৃত দুঃখী ?

অনাচার কাকে বলে ও কয় প্রকার?

কলিযুগের মানুষদের ভগবানের নামে রুচি নেই কেন ? 

ঘট কিসের প্রতীক? 

সনাতন ধর্মের বৈদিক শাস্ত্রে জন্ম ও মৃত্যুযোগ অশৌচ কি?

মহাভারত পড়ার সময় না থাকলেও এর মূল সূত্রগুলি আমাদের জীবনে কার্যকর প্রমাণ করতে পারে----------------------- 

মহাভারতের কিছু বাণী

শ্রীমদভগবদগীতায় উচ্চারিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল নামের অর্থ ও মাহাত্ম্য

প্রকৃত ভালোবাসার খোঁজে.......... 

রাধাকৃষ্ণের প্রেম-কাহিনীর প্রকৃত রহস্য

ভক্তি কি ?

 মায়া কি? মায়া থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন মাথায় ময়ূরপালক/পুচ্ছ পরিধান করতেন?

রাজা পুরঞ্জনের কেন পরবর্তী জন্মে নারী হয়ে জন্ম হয়েছিল ?

 
আরো পড়ুন.....


 
হিন্দুদের কেন গো মাংস খাওয়া উচিত না? গো মাতা কেন সনাতন ধর্মে পূজনীয় ? Why Hindus should not eat beef? Why is Go Mata revered in traditional religion?
অম্বুবাচী (আম্ববর্তী) কি? কেন অম্বুবাচী পালন করা হয়? What is Ambubachi? Why is Ambubachi celebrated?
একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির নতুন বছরের প্রতিজ্ঞাগুলো ঠিক এরকমই হওয়া উচিত--That's the decent thing to do, and it should end there.
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ এবং লীলা পুরুষােত্তম স্বয়ং ভগবান । Lord Krishna is the ultimate cause of all causes and Leela is the best man himself.
মা লক্ষ্মীর কৃপালাভের কিছু মন্ত্র ও আচার-অনুষ্ঠান ! Some mantras and rituals of mother Lakshmi's grace!
ছাত্র-ছাত্রীদের আট প্রকার প্রবণতা বিদ‍্যা অর্জনে বিশেষ বাধা-স্বরূপ: The eight types of tendency of students to acquire knowledge are special obstacles:
 
সনাতন  ধর্মের মূল গ্রন্থসমূহ:Original texts of traditional religion:
গীতার ১৮ টি নামের মাহাত্ব্যঃ Greatness of 18 names of Gita:
কেনো মহাপ্রসাদ আহার করা উচিত?Why should Mahaprasad be eaten?
অক্ষয় তৃতীয়া মাহাত্ম্যঃ Akshay titiya Mahatmyah
শ্রীরাম নবমী তাৎপর্য ও মহিমাঃ Sriram-Nabami-meaning-and-glory
মা মনসার ধ্যান মন্ত্র প্রণাম মন্ত্রঃ মনসা অঞ্জলি : Ma Manasa Dhyana Mantra Pranam Mantra: Manasa Anjali:
রাশি বা লগ্ন অনুসারে জেনে নিন আপনার বৈশিষ্ঠ্য...........
মহা বারুণী স্নান মাহাত্ম্য
চৈত্র সংক্রান্তি Chaitra Sankranti
 
বাসন্তী পূজা
দোল পূর্ণিমা এবং ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি -গৌর পূর্ণিমা
রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনী ও শিক্ষাঃ
দেবাদিদেব মহাদেব শিব চতুর্দশী ব্রত মাহাত্ম্য এবং শিবরাত্রি পূজার সময়সূচি ও নিয়মাবলি
শ্রীমদ্ভগবদগীতা কি? কেন গীতা পড়বেন?
 
অশ্বিনীকুমার ব্রত মাহাত্ম্য
দামোদর মাস ও ব্রত...মাহাত্ম্য
দুর্গাপূজার তাৎপর্য, মহিমা ও  বিভিন্ন তিথির আনুষ্ঠানিকতা এবং সময় নির্ঘণ্টঃ
পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষ বিশেষ তাত্‍পর্য্য
 
একাদশী ব্রত পালনের তাৎপর্য ও নিয়মাবলিঃ
শয়ন একাদশী মাহাত্ম্য
আমলকী একাদশী মাহাত্ম্য
 
পবিত্রারোপণী একাদশী মাহাত্ম্য Pobitrarohini Ekadashi Mahatmya
অন্নদা একাদশী মাহাত্ম্য Annada Ekadashi Mahatmya
পার্শ্ব একাদশী এর মাহাত্ম্য Parsha Ekadashi Mahatmya
ইন্দিরা একাদশী মাহাত্ম্য Indira Ekadashi Mahatmya
 
সফলা একাদশী মাহাত্ম্য Safala Ekadashi Mahatmya
পুত্রদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য Putrada Ekadashi Brata Mahatmya
ষটতিলা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য Shattila Ekadashi Brata Mahatmya
পাপমোচনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য Paapmochani Ekadashi Brata Mahatmya
 
প্রথম অধ্যায়  অর্জুন বিষাদ-যোগ
দ্বিতীয় অধ্যায়  সাংখ্য-যোগ
তৃতীয় অধ্যায়  কর্মযোগ
 
একাদশ-অধ্যায় বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
দ্বাদশ-অধ্যায় ভক্তিযোগ
প্রকৃতি-পুরুষ বিবেকযোগ
 
শিব কল্প তরু শ্রী শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ Shiva Kalpa Taru Sri Srimat Swami Advaitananda Puri Maharaj
শ্রী অদ্বৈত আচার্য
শ্রীগদাধর পণ্ডিত : মহাপ্রভুর ছায়া
 
সংঘাত নিরসনের পন্থা
হরি নামের মহিমা
কামকে কিভাবে জয় করবেন ?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় হতে চান এই গুনগুলোর চর্চা করুনঃ If you want to be dear to Lord Krishna, practice these qualities:
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ