এ পর্বের প্রথম অংশে আমরা জানতে পারব বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডে প্রানী আছে কিনা ?
বর্তমান বিজ্ঞানীদের ধারনা আমাদের সৌর জগতের মত মহাবিশ্বে আরো অসংখ্য সৌর জগত রয়েছে এবং সেসব সৌরজগতের গ্রহগুলিতে বুদ্ধিমান জীব রয়েছে । এ ব্যাপারে ভাগবতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডে অনন্ত কোটি জীব রয়েছে । তবে বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডের পরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন রকমের হওয়ায় জীবগুলোও বৈচত্র্যময় হবে । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে এ মহাবিশ্বে ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব রয়েছে । মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহে অবশ্য মানুষও রয়েছে ।
নভো দদাতি শ্বসতাং পদং যন্নিয়মাদদঃ ।
লোকং স্বদেহং তনুতে মহান্ সপ্তভিরাববৃতম্ ।। (ভাগবত ৩/২৯/৪৩)
অনুবাদঃপরমেশ্বর ভগবানের নিয়ন্ত্রণে আকাশ অন্তরীক্ষে বিভিন্ন গ্রহদের স্থান প্রদান করে, যেখানে অসংখ্য প্র্রাণী বাস করে এবং তারই পরম নিয়ন্ত্রনে সমগ্র ব্রহ্মান্ডের বিরাট শরীর সপ্ত আবরণসহ বিস্তৃত বিশ্বব্রহ্মান্ডের আবরণের ধারণা হয় ।
এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে সমগ্র ব্রহ্মান্ডে অসংখ্য গ্রহে অসংখ্য প্রাণী বাস করে এবং ব্রহ্মান্ডগুলিতে মানুষও রয়েছে । এছাড়া এশ্লোকটিতে বিশ্বব্রহ্মান্ড যে ৭ টি আবরনের দ্বারা তৈরী সে কথাও বলা হয়েছে ।
এখন আমরা জানব এসব ব্রহ্মান্ডে অবস্থানরত মানুষের ধর্ম কি ? তাদের জীবনযাত্রার মান কেমন?
ভাবয়ত্যেষ সত্ত্বেন লোকন্ বৈ লোকভাবনঃ ।
লীলাবতারানুরতো দেবতির্যঙ্ নরাদিষু ।। (ভাগবত ১/২/৩৪)
অনুবাদঃ এভাবে সমস্ত জগতের প্রতিপালক- দেবতা , মানুষ এবং পশু অধ্যুষিত সমস্ত গ্রহগুলো প্রতিপালন করেন । বিভিন্ন অবতাররূপে তিনি তাঁহার লীলা-বিলাস করে বিশুদ্ধ-সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হয়েও জীবসমূহকে উদ্ধার করেন ।
এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে মহাবিশ্বে অনন্ত কোটি জড় ব্রহ্মান্ড রয়েছে এবং প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে অসংখ্য গ্রহ রয়েছে । গ্রহগুলোতে জীবসমূহ প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিরাজ করছে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছায়ারূপে ব্রহ্মান্ডগুলোর গ্রহসমূহে অবতরণ করেন । তিনি বিভিন্ন গ্রহে বিদ্যমান জীবসমূহেরর মাঝে তার বৈদিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন যাতে তারা চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা লাভ করতে পারে । যদিও ভগবান তার অপ্রাকৃত স্থিতির পরিবর্তন করেন না তারপরেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশে এবং বিভিন্ন সমাজে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন বলে মনে হয় । প্রতিটি ব্রহ্মান্ড নিয়ন্ত্রনের করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একজন করে প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছেন তার নাম ব্রহ্মা । ব্রহ্মা , ব্রহ্মলোকে (ব্রহ্মান্ডের সর্বোচ্চ লোক ) বসবাস করেন । ব্রহ্মার ১ দিনকে উক্ত ব্রহ্মান্ডের ১ দিন হিসাবে বিবেচনা করা হয় । বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডের দিবাভাগের সময় উক্ত ব্রহ্মান্ডের আয়তন দ্বারা নির্ধারিত হয় ।
আমরা যে ব্রহ্মান্ডে বাস করছি এটি অন্যান্য ব্রহ্মান্ডগুলোর তুলনায় অনেকটা ছোট । আমাদের ব্রহ্মান্ডের ব্রহ্মার ১ দিন পৃথিবীর ৪৩২ কোটি বছরের সমান । আমাদের পাশ্ববর্তী ব্রহ্মান্ডের আয়তন আমাদের ব্রহ্মান্ডের চেয়ে সামান্য বেশি অতএব সেই ব্রহ্মান্ডের ১ দিন পৃথিবীর ৪৩২ কোটি বছরের কিছু বেশি হবে । এভাবে প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের ১ দিনের পরিমান প্রতিটি ব্রহ্মান্ড থেকে আলাদা । ভাগবতে অনুসারে প্রত্যেক ব্রহ্মান্ডের ১ দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একবার করে সেই ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি গ্রহে যান । আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের ব্রহ্মান্ডের পৃথিবী নামক গ্রহে এসেছিলেন । সে হিসাবে তিনি ৮৬৪ কোটি বছর ( ব্রহ্মার ১ দিন ১ রাত ) পর আবার পৃথিবীতে আসবেন ।
ব্রহ্মার ১ দিনে কৃষ্ণ একবার সেই ব্রহ্মান্ডে যান ব্রহ্মার এক দিনে তিহোঁ একবার ।
অবতীর্ণ হঞা করেন প্রকট বিহার ।। ( চৈতণ্য চরিতামৃত পৃষ্ঠা ১২৬ , শ্লোক ৬ )
অনুবাদঃ ব্রহ্মার ১ দিনে একবার তিনি তার আপ্রাকৃত লীলা প্রকট করার জন্য এই জড় জগতে অবতীর্ণ হন । এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মার ১ দিনে কৃষ্ণ সেই ব্রহ্মান্ডে একবার যান ।
ব্রহ্মান্ড সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের ধারণা (Idea of Scientists About Universe)
ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে বর্তমানে বিজ্ঞানীদের সুস্পষ্ট কোন ধারনা নাই । বিজ্ঞানীরা এখনোও ব্রহ্মান্ড এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডের মধ্যে কোন সুস্পষ্ট পার্থক্য আবিষ্কার করতে পারেন নাই । এর ফলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে তারা যে মতবাদগুলো দিয়েছেন সেগুলো অসম্পূর্ণ এবং পরস্পর বিরোধী । এটা সম্পর্কে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে ।
ভাগবতে যেভাবে প্রতিটি ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে নিঁখুতভাবে বর্ননা করা হয়েছে বিজ্ঞানীরা এখনোও সেভাবে তা আবিষ্কার করতে পারে নাই । যেমন আমরা যে ব্রহ্মান্ডে বাস করি তার ব্যাস ৫০ কোটি যোজন বা ৪০০ কোটি মাইল ( ১ যোজন = ৮ মাইল ) এবং এর আবরণ প্রশস্ততা ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ এবং আবরণগুলো ৭ টি স্তরে বিভক্ত ।
চিন্ময়জগত বা বিপরীত জগত (Otherworldly World or Anti Material World)
ভাগবত অনুসারে মহাবিশ্ব নামক এই জড় জগত ছাড়াও আরো একটি জগত আছে । এর নাম চিন্ময়জগত । মহাবিশ্ব নামক জড় এই জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংস আছে কিন্তু চিন্ময় জগতের কোন সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, চিন্ময় জগত জড় জগতের চেয়ে তিন গুণ বড় এবং ভগবানের এক অংশে এই জড় জগত অবস্থিত ।
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন ।
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ ।। (গীতা ১০/৪২)
অনুবাদঃ হে অর্জুন-অধিক আর কি বলিব , এইমাত্র জানিয়া রাখ যে, আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছি ।
জড়জগত যদি অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডের সমান হয় তবে চিন্ময় জগত কত বড় সেটা আমাদের ধারনার বাইরে । চিন্ময় জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই অর্থাৎ ইহা শাশ্বত নিত্য বস্তু ।
এবার দেখা যাক শাশ্বত চিন্ময় জগত সম্পর্কে গীতা কি বলে ?
পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎসনাতনঃ ।
যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি ।। (গীতা ৮/২০)
অনুবাদঃ আর একটি প্রকৃতি (চিন্ময় জগৎ ) রয়েছে যা নিত্য এবং ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তুর অতীত । ব্রহ্মা থেকে স্থাবর জঙ্গম আদি সমস্ত ভূত বিনষ্ট হইলেও তা বিনষ্ট হয় না ।
এই শ্লোক থেকে চিন্ময় জগৎ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পাওয়া যাচ্ছে । চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ স্থানকে বলা হয় গোলক বৃন্দাবন । গোলক বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিত্যরূপে অর্থাৎ সর্বদা বর্তমান থাকেন অর্থাৎ এটা ভগবানের নিজস্ব বাসস্থান বা ধাম ।
গোলক বৃন্দাবন যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিজস্ব ধাম এটা সম্পর্কে ব্রহ্মসংহিতায় যা বলা হয়েছে তা হলোঃ
আনন্দচিন্ময়রসপ্রতিভাবিতাভি-স্তাভির্য এব নিজরূপতয়াকলাভিঃ গোলক এব নিবসত্যখিলাত্মভ তো গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম সংহিতা ৫/৩৭)
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান গোবিন্দ , যিনি তার সবিশেষ রূপের কিরণের দ্বারা সকলের ইন্দ্রিয়সমূহকে উজ্জীবিত করেন , তিনি গোলোক নামক তার স্বীয় অপ্রাকৃত ধামে সর্বদা বিরাজ করেন যদিও তিনি তার আহ্লাদিনী শক্তির তুল্য আনন্দময় দিব্য কিরণের প্রসারের দ্বারা তার সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজমান ।
এ শ্লোক থেকে আমরা জানতে পারলাম , ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ( গোবিন্দ ) সর্বদা গোলক নামক অপ্রাকৃত বা চিন্ময় ধামে অবস্থান করেন । ভগবান কখনও তার নিজের ধাম ত্যাগ করে কোথাও যান না । তবে যখন জড় জগতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তখন তিনি নিজের থেকে ছায়া কৃষ্ণ তৈরী করে জড় জগতে পাঠান । ভাগবতে উল্লেখ করা হয়েছে ছায়াকৃষ্ণ এবং মূলকৃষ্ণ এক ও অভিন্ন এবং উভয়ের শক্তি সমান । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে আমরা যে জড়জগতে বাস করি সেটা হল চিন্ময় জগতের বিপরীত প্রতিফলন বা বিপরীত অবস্থা । জড় জগতের যেমন সৃষ্টি ও ধ্বংস আছে চিন্ময় জগতের সেরকম সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই অর্থাৎ জড় জগতের বিপরীত অবস্থা চিন্ময় জগৎ । চিন্ময় জগত শাশ্বত, নিত্য এবং অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান । সৃষ্টিকর্তার যেমন সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই ঠিক সেরকমই চিন্ময় জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই । জন্ম, মৃত্যু, জড়াব্যাধি এই সকল বিষয় চিন্ময় জগতে নাই । চিন্ময় জগতে মানুষের বয়স বৃদ্ধি পায় না কারণ সেখানে কাল বা সময়ের কোন প্রভাব নাই ।
চিন্ময় জগতে কালের প্রভাব নাই
প্রবর্ততে যত্র রজস্তমস্তয়োঃ সত্ত্বং চ মিশ্রং ন চ কালবিক্রমঃ ।
ন য্ত্র মায়া কিমুতাপরে হরে- রনুব্রতা যত্র সুরাসুরার্চিতাঃ ।। (ভাগবত ২/৯/১০)
অনুবাদঃ ভগবানের সেই ধামে রজোগুন ও তমোগুণের কোন প্রভাব নাই , এমনকি সেখানে সত্ত্বগুনেরও কোন প্রভাব নাই । সেখানে বহিরঙ্গা মায়াশক্তির প্রভাব তো দূরের কথা, কালেরও কোন প্রভাব নাই । মায়া সেখানে প্রবেশ করতে পারে না । সুর এবং অসুর প্রভৃতি কোনরম ভেদবুদ্ধি না করেই সেখানে সবাই ভগবানের পূজা করেন ।
এই শ্লোক থেকে আমরা বুঝতে পারলাম চিন্ময় জগতে কালের কোন প্রভাব নাই । কাল বা সময় হচ্ছে মূলত এক প্রকার শক্তি । এই শক্তির দ্বারা ভগবান জড় জগতসহ সবকিছু সৃষ্টি , ধ্বংস এবং নিয়ন্ত্রন করেন । কালের প্রভাবে সব কিছু পরিবর্তিত হয় । আজকের যুবক ৫০ বছর পর বৃদ্ধে পরিণত হয় কালের প্রভাবেই । যেহেতু চিন্ময় জগতে কালের কোন প্রভাব নাই, তাই সেখানে সবকিছু অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে ।
চিন্ময় জগতের সব কিছু জীবন্ত অর্থাৎ সেখানে জড় বা প্রাণহীন কোন বস্তু নেই । আমরা জড় জগতে প্রানীর দেহে যে আত্মার উপস্থিতি অনুভব করি সে আত্মা জড় জগত থেকে সৃষ্টি হয়নি । আত্মা চিন্ময় বস্তু অর্থাৎ আত্মা চিন্ময় জগৎ থেকে এসেছে । আত্মার কোন সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই । আত্মাকে সাধারন ভাষায় জীবন বা প্রাণ বলে ।
কিছু বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেছেন গভীর সমুদ্রে সূর্যের আলোর প্রভাবে কতগুলো জড় বস্তু মিলিত হয়ে আত্মা সৃষ্টি হয়েছে । আবার কেউ বলছেন পানি থেকে জীবন সৃষ্টি হয়ছে । আমাদের মনে রাখতে হবে , জড় কিংবা প্রাণহীন বস্তু থেকে জীবন সৃষ্টি হতে পারে না । জীবন বা আত্মা হল উৎকৃষ্ট উচ্চ স্তরের বস্তু সেটা কখনও নিম্নস্তরের জড় বস্তু থেকে সৃষ্টি হতে পারে না । আত্মা চিন্ময় জগত থেকে আত্মার এসেছে এবং চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়াই আত্মার মূল লক্ষ্য । অতএব মানব জীবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়া ।
আত্মা যে চিন্ময় জগত থেকে আসে সে সম্পর্কে গীতায় যা বলা হয়েছে ।
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ ।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ ।। (গীতা ৭/৫)
অনুবাদঃ হে মহাবাহো- এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ( জড় জগত ) ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি ( চিন্ময় জগত ) রয়েছে । সেই প্রকৃতি চৈতন্য স্বরূপা ও জীবভূতা । সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জড় জগতকে ধারন করে আছে ।
এ শ্লোক থেকে বুঝা যায় যে , ভগবানের আরেকটি জগত আছে যা চিন্ময় জগত নামে পরিচিত । চিন্ময় জগৎ জীবভূতা অর্থাৎ সেখান থেকে জড় জগতে (পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহসমূহে ) জীবন বা আত্মা এসেছে । চিন্ময় জগৎ সম্পর্কে গীতায় আরোও বলা হয়েছেঃ
ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো না শশাঙ্কো ন পাবকঃ ।
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ।। (গীতা ১৫/৬)
অনুবাদঃ আমার সেই ধাম ( চিন্ময় জগত ) সূর্য, চন্দ্র অথবা বিদুৎ আলোকিত করতে পারে না । সেখানে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না ।
এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে পরম ধাম বা চিন্ময় জগত- সূর্য , চন্দ্র কিংবা বিদ্যুৎ আলোকিত করতে পারে না । চিন্ময় জগতের জলও জীবন্ত বস্তুর মত ক্রিয়া করে ।
ইত্যুক্তৃদিভাবো দেবো ভক্ষিতাঙ্গং পিপীলিকৈঃ ।
কমন্ডলুলেনৌক্ষদ্দিব্যেনামোঘরাধসা ।। (ভাগবত ৭/৩/২২)
অনুবাদ
শ্রীনারদ মুনি বললেন - হিরণ্যকশিপুকে এই কথা বলিয়া, এই ব্রহ্মান্ডের আদিদেব ব্রহ্মা তাহার কমন্ডুলু থেকে অব্যর্থ দিব্য জল নিয়া পিপীলিকা কর্তৃক ভক্ষিত হিরণ্যকশিপুর দেহে সিঞ্চন করিয়াছিলেন । তাহার ফলে হিরণ্যকশিপুর শরীর পুণরুজ্জীবিত হইয়াছিল । মানুষ উন্নত কর্মের দ্বারা চিন্ময় শরীর লাভ করতে পারে, সেই শরীর দ্বারা সে মহাশূন্য ভ্রমণ করতে পারে এবং ভগবানের সঙ্গ করার সুযোগ পায়।
নারদ মুনির শরীর চিন্ময়
প্রযুজ্যমানে ময়ি তাং শুদ্ধাং ভাগবতীং তনুম্ ।
আরব্ধকর্মনির্বাণো ন্যপতৎ পাঞ্চভৌতিকঃ ।। (ভাগবত ১/৬/২৮)
অনুবাদ
এই শ্লোকে নারদ মুনি তাহার জড় শরীর ত্যাগের পর চিন্ময় শরীর লাভের কথা বর্ণনা করেছেন । চিন্ময় জগতের বিপরীত প্রতিফলন এই জড় জগত বা বিশ্বব্রহ্মান্ড । আমাদের এই মহাবিশ্ব যা দ্বারা তৈরী এর বিপরীত পদার্থ দ্বারা চিন্ময় জগত তৈরী । ভগবানের জড় জগতের ধাম চিন্ময় জগতের প্রতিরূপ কৃষ্ণলোক সম্বন্ধে জীব গোস্বামী স্কন্দ পুরাণের বর্ণনার উল্লেখ করেছেন
যা যথা ভুবি বর্তন্তে পুর্যো ভগবতঃ প্রিয়াঃ তাস্তথা সন্তি বৈকুন্ঠে তদ্ভল্লীলার্থমা দৃতাঃ ।।
জড় জগতে দ্বারকা, মথুরা এবং গোলোক আদি ভগবানের ধামসমূহ চিৎজগতে ভগবতধামের অবিকল । সায়ম্ভূবতন্ত্রে চতুর্দশাক্ষর মন্ত্রের প্রভাব সম্বন্ধে শিব এবং পার্বতীর আলোচনায় তা প্রতিপন্ন হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে চিন্ময় জগতের নীচে জড়জগত অবস্থিত
নানাকল্পলতাকীর্ণং বৈকুন্ঠং ব্যাপকং স্মরেৎ ।
অধঃ সাম্যং গুণানাঞ্চ প্রকৃতিঃ সর্বকারণম্ ।। (চৈতন্য চরিতামৃত ১/৫/১৮
অনুবাদ
মন্ত্র জপ করিবার সময় সর্বদা চিৎজগতের কথা স্মরণ করা উচিত, যাহা অন্তহীনভাবে ব্যাপ্ত এবং সমস্ত মনোরথ পূর্ণকারী কল্পবৃক্ষে পূর্ণ । সেই বৈকুন্ঠলোকের আধোভাগে জড় সৃষ্টির কারণস্বরূপা প্রকৃতি অবস্থিতা । এখানে বর্ণনা করা হয়েছে চিন্ময় জগতের নীচে জড় জগত অবস্থিত ।
চিন্ময় জগত সন্মন্ধে বিজ্ঞানীদের ধারণা (Idea of Scientists about Spiritual World)
চিন্ময় জগত বা বিপরীত জগত সন্মন্ধে বিজ্ঞানীদের সুস্পষ্ট কোন ধরনা নাই তবে চিন্ময় জগতের কিছু ইঙ্গিত বিজ্ঞানীদের বিবরণে পাওয়া যায় ।
ষ্টিফেন হকিং রচিত কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বইটিতে তিনি বর্ণনা করেছেন । বিজ্ঞানীদের ধারনা ইলেকট্রনের নিশ্চয় একটি জুড়ি থাকবে অর্থাৎ থাকবে একটি বিপরীত ইলেকট্রন (Against Electron) কিংবা পজিট্রন । ১৯৩২ সালে পজিট্রন আবিষ্কৃত হয় । ফলে ডিরাকের তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণিত হয়, এই আবিষ্কার ১৯৩৩ সালে ডিরাকের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির পথিকৃৎ । আমরা এখন জানি প্রতিটি কণিকারই একটি বিপরীত-কণিকা (Anti-Particle) আছে । তাহার সঙ্গে কণিকাটি বিনাশপ্রাপ্ত (annhilated) হতে পারে (বলবাহী কণাগুলির ক্ষেত্রে বিপরীত কণিকা এবং কণিকাটি অভিন্ন) । বিপরীত কণিকা দ্বারা গঠিত বিপরীত পৃথিবী এবং বিপরীত মানুষও থাকতে পারে । কিন্তু আপনার বিপরীত সত্তার সঙ্গে দেখা হলে তাহার সঙ্গে করমর্দন করবেন না । তা করিলে আলোর ঝলকে মিলাইয়া যাবেন ।
বিজ্ঞানীদের এ বর্ণনা থেকে ধারনা করা যায় তারা একটি বিপরীত জগতের কথা ভাবিতেছেন এবং বিপরীত পদার্থের মানুষ থাকাও সম্ভব বিজ্ঞানীদের এই ধারনা আংশিকভাবে চিন্ময় জগতকে ইঙ্গিত করে ।
একটি পরমাণু ইলেকট্রন (Electron), প্রোটন (Proton) এবং নিউট্রন (Neutron) কণিকা দ্বারা গঠিত । ২০(বিশ) বছর আগ পর্যন্ত মনে করা হত এইগুলি মৌল কণিকা । কিন্তু ১৯৬৯ সালে বিজ্ঞানী মারে গেলম্যান (Murray Gell Mann) প্রমাণ করেন নিউট্রন এবং প্রোটন কার্ক (Quark) নামক কণিকা দ্বারা গঠিত । প্রতিটি নিউট্রন এবং প্রোটন ৩টি করে কার্ক দ্বারা গঠিত । এ আবিষ্কারের জন্য গেলম্যান সাহেব নোবেল প্রাইজ পান । এখন পর্যন্ত কার্ককে মৌল কণা হিসাবে বিবেচনা করা হয় ।
অন্যান্য নীহারিকাতে পদার্থ প্রোটন এবং নিউট্রন অথবা বিপরীত প্রোটন এবং বিপরীত নিউট্রন দ্বারা গঠিত কিনা এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কোন প্রত্যক্ষ প্রমান নাই । একই নীহারিকাতে দুইয়ের মিশ্রণ থাকতে পারে না । কতগুলি নীহারিকা পদার্থ দিয়ে গঠিত এবং কতগুলি নীহারিকা বিপরীত পদার্থ দিয়ে গঠিত এরকম সম্ভবনা নাই ।
বিপরীত কার্কের তুলনায় কার্কের সংখ্যা অত বেশী কেন ? দুইয়ের সংখ্যা এক না হওয়ার কারণ কি ? দুইয়ের সংখ্যা সমান না হওয়া আমাদের সৌভাগ্য । তাহার কারণ, সে রকম হলে সমস্ত কার্ক এবং বিপরীত কার্ক মহাবিশ্বের আদিমকালে পরস্পরকে ধ্বংস করিয়া ফেলিত । মহাবিশ্ব বিকিরণে ভর্তি থাকিত, কিন্তু বিশেষ কোন পদার্থ থাকত না । মনুষ্যজীবন বিকাশ লাভ করবার মতো কোন নীহারিকা, কোন তাঁরকা, কোন গ্রহ থাকত না । শুরুতে যদি দুইয়ের সংখ্যা সমান থাকিয়াও থাকে, তা হলে এখন কার্কের সংখ্যা এত বেশী কেন ? সৌভাগ্যক্রমে সে সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বগুলি একটি ব্যাখ্যা দিতে পারে । আমরা দেখেছি উচ্চশক্তিতে কার্কের বিপরীত ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হওয়ার অনুমোদন Gut-এর আছে । এর বিপরীত পদ্ধতি অর্থাৎ কার্কের ইলেকট্রনের রূপান্তর এবং ইলেকট্রন বিপরীত ইলেকট্রনে রূপান্তর তাহারা অনুমোদন করে । মহাবিশ্বের অতি আদিম যুগে একটা সময় ছিল যখন মহাবিশ্ব এত উত্তপ্ত হওয়ার ফলে কণিকা শক্তি এত উচ্চমানের হত যে এই সমস্ত রূপান্তর সম্ভবপর ছিল কিন্তু তাহার ফলে কার্কের সংখ্যা বিপরীত কার্কের চাইতে বেশী হইবে কেন ? তার কারন পদার্থবিদ্যার বিধিগুলি কণিকা এবং বিপরীত কণিকার ক্ষেত্রে অভিন্ন নয় ।
আপনি যদি সমস্ত কণিকা এবং প্রতিকণিকার গতি বিপরীতমুখী করে দেন, তা হলে তন্ত্রটি (system) অতীত কালে যা ছিল সে অবস্থায় ফিরে যাবে । অর্থাৎ বিধিগুলি কালের সম্মুখ অভিমুখে এবং পশ্চাৎ অভিমুখে একই হবে ।
১৯৫৬ সালে সুং দাও লী (Tsung Dao Lee) এবং চেন নিং ইয়াং (Chen Ning Yang) নামে দুজন আমেরিকান পদার্থবিদ প্রস্তাবনা করেন যে, আসলে দুর্বল বল (weak force) প্রতিসাম্য P মানে না ।
পরের বছর লী এবং ইয়াং তাহাদের চিন্তাধারা জন্য নোবেল পুরষ্কার পান । এইও দেখা গিয়েছিল যে, দুর্বল বল প্রতিসাম্য-C মেনে চলে না ।
অর্থাৎ এর ফলে বিপরীত কণিকা দিয়ে গঠিত মহাবিশ্বের আচরণ আমাদের মহাবিশ্বের চাইতে পৃথক হবে ।
আদিম মহাবিশ্ব অবশ্যই প্রতিসাম্য-T মানে না: সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয় । সময়ের অভিমুখ পশ্চাদ্ বর্তী হলে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হবে । এই আলোচনার মাধ্যমে বিজ্ঞানীর মতামত প্রকাশ করেছেন, মহাবিশ্বের বিপরীত কার্কের (Anti Quark) তুলনায় কার্কের (Quark) সংখ্যা এত বেশী কেন ?
এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেছেন কার্ক এবং বিপরীত কার্কের সংখ্যা সমান হলে একে অপরকে ধ্বংস করিয়া ফেলিত, সেজন্য কার্কের সংখ্যা বেশি ।
আবার বিজ্ঞানী Gut অনুমোদন করেছেন উচ্চ তাপমাত্রা কার্ক থেকে এন্টিকার্ক বা বিপরীত কার্ক হতে পারে এবং বিপরীত কার্ক থেকে কার্ক হতে পারে । সহজভাবে বলা যেতে পারে পদার্থ থেকে বিপরীত পদার্থ এবং বিপরীত পদার্থ থেকে পদার্থ হতে পারে ।
এই বিষয়টি ভাগবতে আরো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে । ভাগবতে পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পরবর্তীতে মহাবিশ্ব সূষ্টি পর্বে আলোচনা করিব ।
মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যঃ (ভাগবতের আলোকে) পর্ব-০১ The secret of the creation of the universe:
ভাগবতে মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বর্ননা রয়েছে । বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে যে বর্ননা দিয়েছেন তা মূলত ভাগবতের পুরো বর্ননার …
আরও পড়ুন »
0 মন্তব্যসমূহ